২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে গুজরাতের রাজকোটে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ বোলার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলিং করতেন। এছাড়াও, বামহাতে নিচরসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।
১৯৬৮-৬৯ মৌসুম থেকে ১৯৮৬ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে বাংলা ও সৌরাষ্ট্র এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে নটিংহ্যামশায়ার ও ওয়ারউইকশায়ারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, হার্টফোর্ডশায়ারের পক্ষে খেলেছেন।
বামহাতে ধীরলয়ে বোলিং করতেন। বুদ্ধিমত্তা সহযোগে ধৈর্য্যশীল বোলার হিসেবে বলকে বেশ ঘুরাতে পারতেন। ১৯৬৮ সালে নিজ দেশে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। নিয়মিতভাবে রঞ্জী ট্রফিতে বাংলা দলের পক্ষে এবং দিলীপ ট্রফিতে পূর্বাঞ্চলের পক্ষে খেলতেন। অবশেষে, ত্রিশের বয়সে এসে ভারতের পক্ষে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভারতের পক্ষে হয়তোবা শত টেস্ট খেলার সুযোগ পেতেন। রাজিন্দার গোয়েল ও পদ্মকর শিবলকরের ন্যায় তাঁকেও বিষেন সিং বেদী’র কারণে নিরাশ হতে হয়েছিল।
১৯৭০-এর দশকে জনপ্রিয় স্পিন চতুষ্টয়ের পদাঙ্ক অনুসরণে খেলায় অংশ নেন। নটিংহ্যামশায়ারে থাকাকালীন বিখ্যাত কিংবদন্তী গারফিল্ড সোবার্সের স্নেহধন্য ছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় ক্রিকেটের সাথে তাল মিলাতে না পেরে অনেকটা নিরবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে চলে যান।
পুরো চশমা, বোতাম সহযোগে পূর্ণ হাতা সহযোগে যুবক বয়সে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে বিষেন সিং বেদী’র দলে উপস্থিতি এবং শেষের দিনগুলোয় বিশেষ করে ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে পাকিস্তান সফরে অধিনায়ক সুনীল গাভাস্কারের সাথে তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া ও সহযোগিতার অভাবে পিষ্ট হন। এ সকল প্রতিকূলতা থাকা স্বত্ত্বেও ঐ সময়ে অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের মর্যাদা পান। নিজ দেশে অন্যতম সেরা ভারতীয় স্পিনার হিসেবে গণ্য হতেন। বিষেন সিং বেদী’র খেলোয়াড়ী জীবন শেষ হবার পরই কেবলমাত্র টেস্ট খেলার সুযোগ পান।
নিজ দেশের পক্ষে খেলার পূর্বে কিছু সময় ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে সমীহ জাগানো বামহাতি স্পিনার হিসেবে খেলেছিলেন। ১৯৭০-এর দশকে নটিংহ্যামশায়ারের পক্ষে খেলেন। এরপর, ভারতের পক্ষে টেস্ট ও একদিনের আন্তর্জাতিকে অংশ নেন। ১৯৭২ সালে সাসেক্স দ্বিতীয় একাদশের পক্ষে খেলে ইংরেজ ক্রিকেটের স্বাদ প্রথমবারের মতো আস্বাদন করেন। পরের বছর নটিংহ্যামশায়ারের সাথে যুক্ত হন। এ সময়ে ইংরেজ ক্রিকেটে বিদেশী খেলোয়াড়ের অংশগ্রহণের বিষয়ে শর্তারোপ করায় দলটির পক্ষে অংশগ্রহণ অনেকাংশেই সীমিত পর্যায়ের ছিল। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ – এ দুই ইংরেজ মৌসুমে নটসের দ্বিতীয় একাদশের পক্ষে ১৭ খেলায় অংশ নিয়ে ৭৭ উইকেট দখল করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে ট্রেন্ট ব্রিজে সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান একাদশের বিপক্ষে নটিংহ্যামশায়ারের সদস্যরূপে ইংরেজ প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অভিষেক ঘটে। তবে, কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের খেলায় অংশগ্রহণের জন্যে তাঁকে মনোনীত করা হয়নি। ফলে, অংশগ্রহণকৃত পাঁচ খেলা কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দল ও সফররত আন্তর্জাতিক দলগুলোর বিপক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১৯৭৫ সালে কাউন্টি দলের পক্ষে খেলেননি। তবে, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের জন্যে পুণরায় চুক্তিবদ্ধ হন। নিয়মের পরিবর্তন ঘটানোয় দুইজন বিদেশী খেলোয়াড়ের অন্যতম হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্লাইভ রাইসের সাথে ১৯৭৭ সালের অধিকাংশ সময় খেলেন। মে মাসে নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নশীপে তাঁর অভিষেক হয়। নটিংহ্যামশায়ারের ৪৬৪তম প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড় তিনি। ২৫টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়ে ৮২ উইকেট দখল করেন ও কাউন্টি ক্যাপ লাভ করেন।
১৯৭৮ সালে রিচার্ড হ্যাডলি’র চুক্তিবদ্ধতার কারণে দলে তাঁর অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে। তাসত্ত্বেও, ১৪টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়ে ৪৭ উইকেট পেয়েছিলেন। এছাড়াও, সাতটি লিস্ট-এ ক্রিকেট খেলায় অংশ নেন। পরের মৌসুমে তিনি আর দলের সাথে চুক্তি নবায়ণ করেননি। নটসের পক্ষে চার মৌসুমে ৪৪টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়ে ১৫৭ উইকেট দখল করেন। জুলাই, ১৯৭৮ সালে শেষ কাউন্টি খেলায় চ্যাম্পিয়নশীপে তাঁর সেরা বোলিং করেন। নিউয়ার্কের র্যানসাম এন্ড মার্লস মাঠে অনুষ্ঠিত খেলায় ওরচেস্টারশায়ারের প্রথম ইনিংসে ৬/৬৭ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৪/৬৯ নিয়ে খেলায় দশ উইকেট লাভ করেন।
এরপর তিনি ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে অংশ নেন। এক বছর বাদে তাঁকে ভারত দলে খেলার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেক আগেই হয়তোবা তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিতে পারতেন। কিন্তু, বিষেন সিং বেদী ভারত দলে বামহাতি স্পিনার হিসেবে স্বীয় স্থান পাকাপোক্ত করে রেখেছিলেন। বিষেন সিংয়ের অবসর গ্রহণের পরই কেবলমাত্র দিলীপ দোশীকে দলে ঠাঁই দেয়া হয়।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৩ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ৩৩ টেস্ট ও ১৫টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৯-৮০ মৌসুমে নিজ দেশে কিম হিউজের নেতৃত্বাধীন অজি দলের মুখোমুখি হন। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯ তারিখে ৩২ বছর বয়সে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। চশমা পরিহিত দিলীপ দোশী প্রথম ইনিংসে ৬/১০৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, দ্বিতীয় ইনিংসে ২/৬৪ লাভ করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও ছয়-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
সিরিজের চূড়ান্ত টেস্টে আট উইকেট দখল করে ভারতের ইনিংস বিজয়ে দারুণ ভূমিকা রাখেন। ঐ সিরিজে ২৭ উইকেট দখল করেছিলেন তিনি। ঐ সিরিজের প্রত্যেক টেস্টেই খেলানো হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কপিল দেবের প্রধান বোলিং পরিচালনা শক্তিতে পরিগণিত হন। এরপর থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত ভারত দলে নিয়মিত সদস্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী তিন বছর সর্বদাই তাঁকে দলে খেলতে দেখা যেতো। অভিষেকের পর থেকে ৩ বছরে ২৮ টেস্টে অংশ নিয়ে এ কৃতিত্বের অধিকারী হন।
টেস্টগুলো থেকে ১১৪ উইকেট দখল করেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৩০ বছর বয়স অতিবাহিত হবার পর ক্ল্যারি গ্রিমেটের পর দ্বিতীয় ও চারজন বোলারের অন্যতম হিসেবে ১০০ উইকেট পান।
বল হাতে অনেকগুলো স্মরণীয় সফলতার পাশাপাশি ব্যাট হাতে নিয়েও দারুণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৯৮১-৮২ মৌসুমে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দূর্দান্ত ভূমিকা রাখেন। প্রতিপক্ষের সংগ্রহ এক পর্যায়ে ৯৫/১ হলেও পরবর্তীতে ২৯.১-১২-৩৯-৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়ে ১৬৬ রানে গুটিয়ে দেন। পরবর্তীতে, রোমাঞ্চপূর্ণ জয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। মেলবোর্নে আরেকটি সাফল্য পান। অস্ট্রেলিয়া দল স্বল্প সংগ্রহের দিকে ধাবিত হয়। কপিল দেবের আঘাতের কারণে তাঁকে শুরু থেকেই বোলিং আক্রমণে অগ্রসর হতে হয়। গ্রায়েম উড ও কিম হিউজকে বিদেয় করে পেসারের অভাব পূরণ করে দেন ও ভারতের নাটকীয় জয়ে বিরাট ভূমিকা রাখেন।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমে নিজ দেশে বান্দুলা বর্ণাপুরা’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৮২ তারিখে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সফররত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের একমাত্র টেস্টে অংশ নেন। ৫/৮৫ ও ৩/১৪৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, দিলীপ মেন্ডিসের জোড়া শতকের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায়।
১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে নিজ দেশে জহির আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের মুখোমুখি হন। ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩ তারিখে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত সফররত পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। ১/৫২ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, মদন লালের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কারণে খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয় ও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ০-০ ব্যবধানে অগ্রসর হতে থাকে। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
১৯৮০ ও ১৯৮১ সালে ওয়ারউইকশায়ারের অন্যতম বিদেশী খেলোয়াড় হিসেবে যুক্ত হন ও ইংরেজ ক্রিকেটে ফিরে আসেন। পাশাপাশি, ১৯৮৬ সালে অবসর গ্রহণের পূর্বে ভারতের পক্ষে খেলা চলমান রাখেন। তাঁর ওডিআই খেলোয়াড়ী জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও সমসাময়িক অনেক খেলোয়াড়ের তুলনায় সেরা ছিল। তবে, বল হাতে নিয়ে নিয়মিতভাবে দলে অবদান রাখতে পারেননি।
পরবর্তীতে নিজ দেশে সফলতম ব্যবসায়ী হিসেবে আবির্ভূত হন। এছাড়াও, এনট্র্যাক ইন্ডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। নটিংহ্যামশায়ারের পক্ষে খেলাকালীন নটিংহামে অবস্থানকালে তাঁর পুত্র নয়ন দোশী জন্মগ্রহণ করে ও সৌরাষ্ট্রসহ আইপিএল, সারে ও ডার্বিশায়ারের পক্ষে খেলেছে। স্বীয় আত্মজীবনী ‘স্পিন পাঞ্চ’ প্রকাশ করেন ও ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর এ গ্রন্থ বেশ সাড়া জাগায়। পাশাপাশি গ্রন্থটি বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করে। ক্রিকেট খেলায় তাঁকে নিয়মিত দেখা যেতো। প্রায়শঃই রোলিং স্টোন্সের মিক জাগেরের সাথে সময় কাটাতেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তাঁদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান ছিল।
২৩ জুন, ২০২৫ তারিখে হৃদযন্ত্রক্রীয়ায় আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে ৭৭ বছর ১৮৩ দিন বয়সে তাঁর দেহাবসান ঘটে। মৃত্যুকালীন স্ত্রী কালিন্দি, সারে ও সৌরাষ্ট্রের ক্রিকেটার পুত্র নয়ন ও কন্যা বিশাখাকে রেখে যান।
