Skip to content

বিনু মানকড়

1 min read

১২ এপ্রিল, ১৯১৭ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জামনগর এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ভারত দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডার ছিলেন। নিজের স্বর্ণালী সময়ে যে-কোন বিশ্ব একাদশে ঠাঁই পাবার অধিকারী ছিলেন। পেশাদারী পর্যায়ে ভারতের প্রথম ও প্রকৃত ক্রিকেটারের মর্যাদা পেয়েছেন। বিদ্যালয় জীবন থেকে শুরু করে আজীবন ক্রিকেটারদের কাছ থেকে আদুরে ‘বিনু’ ডাকনামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৩৫-৩৬ মৌসুম থেকে ১৯৬১-৬২ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে বাংলা, গুজরাত, হিন্দু, মহারাষ্ট্র, বোম্বে, নয়ানগর, রাজস্থান ও ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

১৯৩৫ সালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন শুরু করেন। তবে, ১৯৩৭-৩৮ মৌসুমে ২০ বছর বয়সে লর্ড টেনিসনের নেতৃত্বাধীন সফররত এমসিসি দলের বিপক্ষে প্রথম নিজেকে মেলে ধরতে সচেষ্ট হন। দ্বিতীয় অনানুষ্ঠানিক টেস্টে ৩৮ ও ৮৮ রান তুলেন। পাশাপাশি দুই ওভার বোলিং করে দুই উইকেট লাভ করেন। পঞ্চম অনানুষ্ঠানিক টেস্টে তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ১১৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলাসহ ৩/১৮ ও ৩/৫৫ পান। ভারত দল ইনিংস ব্যবধানে জয় পায়। ঐ সিরিজে ৬২.৬৬ গড়ে রান পান ও বল হাতে ১৪.৫৩ গড়ে উইকেট লাভ করেন। ফলশ্রুতিতে, লর্ড টেনিসন মন্তব্য করেছিলেন যে, বিশ্বের যে-কোন একাদশে তিনি জায়গা করে নেয়ার অধিকারী হবেন।

১৯৪৬ থেকে ১৯৫৯ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ৪৪ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। এ পর্যায়ে পাঁচ শতক সহযোগে ৩১.৪৭ গড়ে ২১০৯ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, ৩২.৩১ গড়ে ১৬২ উইকেট দখল করেন। তন্মধ্যে, দুইবার ইনিংসে ৮-উইকেট লাভ করেছেন। প্রতি উইকেট লাভে ৯০.৬০ স্ট্রাইক রেটে বোলিং করেছেন। তবে, অংশগ্রহণকৃত টেস্টগুলোয় ভারত দল মাত্র পাঁচটিতে জয়লাভে সক্ষম হয়েছিল। দূর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ী জীবনে স্বর্ণালী সময়কে টেনে আনতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তাঁর টেস্ট অভিষেক পর্ব দেরীতে সম্পন্ন হয়।

১৯৪৬ সালে ইফতিখার আলি খান পতৌদি’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের সাথে ইংল্যান্ড গমন করেন। অবিভক্ত ভারতের সর্বশেষ বিদেশ সফরে ২৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। ২২ জুন, ১৯৪৬ তারিখে লর্ডসে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রুসি মোদি, সাদু সিন্ধে, বিজয় হাজারে, আব্দুল কারদার ও গুল মোহাম্মদের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। অভিজ্ঞতাবিহীন দলে নিজেকে মেলে ধরতে বেশ চেষ্টা চালান। তেমন মন্দ খেলেননি। বিজয় মার্চেন্টের সাথে ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৩ রান তুলেন। এছাড়াও, প্রথম ইনিংসে ১৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন। পাশাপাশি, ২/১০৭ ও ০/১১ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। স্বাগতিক দল ১০ উইকেটে জয় পায় ও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।

সিরিজের বাকী টেস্টগুলোয় মুশতাক আলীকে খেলানো হলে তাঁকে নিচের অবস্থানে চলে যেতে হয়। তেমন রান তুলতে পারেননি। তবে, ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস থেকে ৫-উইকেট লাভ করেছিলেন। আঘাতের কারণে সাময়িকভাবে দ্রুতগতিতে বোলিংয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পর এ সাফল্য পান। ইংল্যান্ড সফরে ১১২০ রান ও ১২৯ উইকেট পেয়েছিলেন। একমাত্র ভারতীয় হিসেবে এ অর্জনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন ও এরপর থেকে অন্য কোন সফরকারী দলের কোন সদস্য এ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেননি।

এরপর, ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় ঘটনাবহুল সফরে অংশ নেন। ডন ব্র্যাডম্যানের নেতৃত্বাধীন দলটি সফরকারীদের উপর একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে। তবে, স্ব-মহিমায় ভাস্বর থেকে দুইটি শতরানের ইনিংস খেলেন তিনি। উভয় শতকই মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় ও পঞ্চম টেস্ট থেকে পান। এ রানগুলো ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমে রে লিন্ডওয়াল ও কিথ মিলারের বোলিং আক্রমণ মোকাবেলা করে পান। তেমন উইকেট না পেলেও তিনি প্রতিপক্ষের কাছে দুষ্প্রাপ্য উইকেট হিসেবে বিবেচিত হন।

সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে স্ট্রাইকবিহীন অবস্থায় ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসায় বোলিং না করে বিল ব্রাউনকে রান আউট করেন। এরপূর্বে প্রস্তুতিমূলক খেলায় সতর্কতার পর একইভাবে বিল ব্রাউনকে বিদেয় করেছিলেন। তবে, মানকড়ের এ ধরনের খেলার প্রেক্ষিতে মতবিরোধ ঘটে। অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যমে তাঁর এ ভূমিকায় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। ভিক রিচার্ডসন তাঁর পার্শ্বে এগিয়ে আসলেও জ্যাক ফিঙ্গলটন তা সমর্থন করেননি। ইংরেজ টেস্ট ক্রিকেটার ও সাংবাদিক কেএস দিলীপসিংজী মন্তব্য করেন যে, এটি অপ্রীতিকর হিসেবে বিবেচিত হবে। এ প্রক্রিয়ায় আউটকে খুব শীঘ্রই অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেটীয় পরিভাষায় ঠাঁই দেয়া হয় ও কোন খেলোয়াড় এভাবে ব্যাটসম্যানকে আউট করলে ‘মানকড়ীয়পন্থা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সর্বোপরী এ রান-আউটের কারণে নিজেকে সর্বাধিক পরিচিতি করে তুলেন।

তবে, বিল ও’রিলি তাঁর পার্শ্বে ছিলেন। ব্র্যাডম্যান স্বয়ং তাঁর পক্ষাবলম্বন করেন ও ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ শীর্ষক আত্মজীবনীতে তা উল্লেখ করেন। ‘স্বীয় দৃষ্টিকোণে বুঝতে পারছি না যে কেন তাঁর ক্রীড়াশৈলীর বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ক্রিকেটের আইনে বিবৃত রয়েছে যে বল হাত ছেড়ে চলে আসার পরপরই কেবলমাত্র স্ট্রাইকবিহীন ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে আসতে পারবেন। যদি তা না থাকতো তাহলে কেন বোলার তাঁকে রান আউট করবেন? বরঞ্চ এরফলে ঐ ব্যাটসম্যান অবৈধ সুবিধে লাভের আশায় বেরিয়েছিলেন।’ এছাড়াও, তিনি বিজয় হাজারে, লালা অমরনাথও বিনু মানকড়কে ভারত দলের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন।

১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় বিপর্যয়কর সফরেও দুটি শতক হাঁকিয়েছিলেন। ডন ব্র্যাডম্যান তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। ‘বিস্ময়করভাবেই তিনি ব্যাট হাতে সফলতা পেয়েছিলেন। এরপরপরই বল হাতেও বেশ সফল হন। ফাস্ট বোলিং বাদে তিনি বেশ ভালো ব্যাটিং করতেন। রে লিন্ডওয়ালকে প্রায়শঃই তাঁর উইকেট নিতে দেখা যায়।’

সাড়ে চার বছর পর ফ্রেড ট্রুম্যানের ন্যায় দূরন্ত গতির পেস বোলারকে কোনরূপ ইতস্তততা ব্যতিরেকেই মোকাবেলা করেন। বল হাতে নিয়েও একই প্রকৃতির খেলা উপহার দিতেন।

১৯৪৭ সাল থেকে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। শীতকালে ভারতে অবস্থান করতেন। ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ড সফরকালে ভারত দলের পক্ষে কেবলমাত্র টেস্ট খেলাগুলোয় অংশগ্রহণে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯৫১-৫২ মৌসুমের শীতকাল ও পরবর্তী গ্রীষ্মে এ অল-রাউন্ডারের কিছু সেরা খেলা প্রদর্শন করতে দেখা যায়।

১৯৫২ সালের গ্রীষ্মে লর্ডসে ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যকার সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি ‘মানকড়ের টেস্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অল-রাউন্ডার হিসেবে নিজের সেরা খেলা উপহার দিয়েছিলেন। স্পিনে সাফল্যের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকলেও ব্যাট হাতেও তিনি সফল ছিলেন। ইনিংস উদ্বোধনে নামেন। প্রথম অর্ধ-ঘণ্টায় রলি জেনকিন্সের বলে সোজা ছক্কা হাঁকিয়ে নার্সারি প্রান্তের সাইট স্ক্রীন পাড় করেন। নির্ধারিত সময়ের অনেক পূর্বেই অবশ্য ইংল্যান্ড দল আট উইকেটে জয় পায়। ভারতের প্রথম ইনিংসে সংগৃহীত ২৩৫ রানের মধ্যে এ অল-রাউন্ডার ৭২ রান তুলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। লেন হাটনের ১৫০ রান ও গডফ্রে ইভান্সের শতকের কল্যাণে ইংল্যান্ড দল ৫৩৭ রান তুললেও তিনি ৭৩ ওভার বোলিং করে ৫/১৯৬ পান। তন্মধ্যে, ২৪ ওভার মেইডেন ছিল। পাঁচ-উইকেট লাভের সুবাদে লর্ডস অনার্স বোর্ডে প্রথমবার নাম লিপিবদ্ধ করেন।

দ্বিতীয় ইনিংসে পিঠ দেয়ালে ঠেকে থাকা অবস্থায় ঐ দিন ৩১ ওভার বোলিং করে ইনিংস উদ্বোধনে যান। সাড়ে চার ঘণ্টা ব্যাটিং করে নিজের সেরা খেলা উপহার দেন। অধিনায়ক বিজয় হাজারে তৃতীয় উইকেটে তাঁর সাথে ২১১ রান যুক্ত করেন। এরফলে, উভয় ইনিংসেই ভারতের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের মর্যাদা পান। চতুর্থ দিনের মধ্যাহ্নভোজনের ২০ মিনিট পর ২৭০ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে ১৯ চার ও এক ছক্কার সহায়তায় ১৮৪ রান তুলে জিম লেকারের বলে বিদেয় নেন। এরফলে, টেস্টের শুরু থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বাদে বাদ-বাকী সময়টুকু মাঠে অবস্থান করেন। এছাড়াও, প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে লর্ডসে টেস্ট শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন। ভারত দলকে ৩৭৮ রানে নিয়ে যেতে সবিশেষ ভূমিকা রাখেন। মামুলী ৭৭ রানে অগ্রসর হলে ইংল্যান্ড দল ৫০ ওভারের মধ্যেই কাঙ্খিত জয়লাভসহ সিরিজ জয় করে। তাসত্ত্বেও, সর্বত্র তাঁর গুণগান প্রচারিত হতে থাকে। তবে, তাঁর এ অবদান সন্দেহাতীতভাবে টেস্টে পরাজিত হওয়া দলের সদস্যরূপে সেরা সাফল্য ছিল।

বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক নেভিল কারডাস মন্তব্য করেন যে, ‘লর্ডসের টেস্ট থেকে ভারত দলের উত্থান ঘটে। বিনু মানকড় ও বিজয় হাজারে এর মধ্যমণি ছিলেন। নান্দনিকতা ও উজ্জ্বীবনী শক্তির দিক থেকে খেলাটিকে আমি ভারতের হিসেবে গণ্য করবো।’ দূর্দান্ত ব্যাটিং ও বোলিং করার সুবাদে কিথ মিলারের পর দ্বিতীয় বিদেশী খেলোয়াড় হিসেবে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে একই টেস্টে দ্বিতীয়বার স্বীয় নাম লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে ইয়ান বোথাম লর্ডসের একই টেস্টে শতক ও অর্ধ-শতক করে তাঁর রেকর্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। নেভিল কারডাসের অভিমত, হ্যাসলিংডেনে তাঁর অসাধারণ খেলা প্রদর্শন সত্ত্বেও ল্যাঙ্কাশায়ার লীগের দলগুলোর তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করেনি।

১৯৫২ সালে মাদ্রাজে ব্যাটিং উপযোগী পিচেও দারুণ খেলেন। ইংরেজ ব্যাটসম্যানদের উপর ছড়ি ঘোরান। ৮/৫৫ ও ৪/৫৩ বোলিং করে করে ভারতের ইতিহাসের প্রথম টেস্ট জয়ে প্রায় একাকী দূর্দান্ত ভূমিকা রাখেন। ঐ গ্রীষ্মেই লর্ডসে ‘মানকড়ের টেস্ট’ নামে পরিচিত খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। ঐ মৌসুমে এটিই তাঁর প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রথম খেলা ছিলেন। চুক্তিবদ্ধতার সমস্যায় প্রথম টেস্ট খেলায় তিনি অংশ নিতে পারেননি।

পরবর্তী শীতকালে সফরকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে বিরাটভাবে সফল হন। দিল্লি টেস্টে ৮/৫২ ও ৫/৭৯ লাভ করে ভারতের দ্বিতীয় টেস্ট জয়ে ভূমিকা রাখেন। এক পর্যায়ে তিনি দলকে পরিচালনা করার সুযোগ পান। ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে পাকিস্তান সফরে দলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। তবে, এ সিরিজটি সর্বকালের অন্যতম স্থবির সিরিজের মর্যাদা পায়। একবার পাঁচ-উইকেট পেলেও বাদ-বাকী সময় ব্যাট কিংবা বল হাতে নিয়ে তেমন সফল হননি।

১৯৫৫-৫৬ মৌসুমে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরবর্তী সিরিজে অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট এ ক্রিকেটার কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যাটিংশৈলী প্রদর্শন করেন। নিজ দেশে হ্যারি কেভের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। সফরকারী দলের বিপক্ষে ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ২২৩ রান তুলেন ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট ভারতের ইনিংস বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এরপর, ৬ জানুয়ারি, ১৯৫৬ তারিখে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। কয়েকটি ব্যক্তিগত সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ২২৩ রান অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে ২২৯ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ২০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। দলের একমাত্র ইনিংসে ব্যাট হাতে নিয়ে ২৩১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। পঙ্কজ রায়ের সাথে উদ্বোধনী জুটিতে ৪১৩ রান তুলে যে-কোন উইকেটে তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড গড়েন। তাঁদের এ জুটি আট ঘণ্টার অধিক সময় টিকেছিল ও কেবলমাত্র দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্নভোজনের পর তাঁরা পৃথক হয়ে যান। ২০০৮ সালে নীল ম্যাকেঞ্জি ও গ্রায়েম স্মিথ বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪১৫ রানের জুটি গড়ে তাঁদের কৃতিত্বকে ম্লান করে দেয়ার পূর্বে ৫২ বছর তাঁদের এ রেকর্ডটি টিকেছিল। এ পর্যায়ে তিনি ২৩১ রানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ সংগ্রহ করেন। ১৯৮৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সুনীল গাভাস্কার ২৩৬ রান তুলে তাঁকে টপকে যাবার পূর্বে ভারতীয় এ রেকর্ডটি ২৮ বছর টিকে। এরপর, দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেট নিয়ে স্বাগতিকদের আরেকটি বিজয়ে অংশ নেন। বল হাতে নিয়ে ০/৩২ ও ৪/৬৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। সফরকারীরা ইনিংস ও ১০৯ রানে পরাজিত হলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়। ঐ সিরিজে ১০৫ গড়ে রান পেয়েছিলেন। এটিই তাঁর স্বর্ণালী সময় ছিল।

পরের বছর অস্ট্রেলিয়া দল ভারত সফরে আসে। শীর্ষসারিতে ব্যাটিংয়ে নেমে রে লিন্ডওয়ালের দূর্দান্ত বোলিংয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। মাদ্রাজে অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলারের তোপে শেষ চেষ্টা চালান। ব্রাবোর্নে পরের ইনিংসে স্ট্রোকের পুণরাবৃত্তি ঘটাতে স্লিপে কট আউটে বিদেয় নেন। এরফলে, তৃতীয় টেস্টে কিছুটা নিচেরদিকে নিজেকে নিয়ে যান। পাশাপাশি রিচি বেনোও তাঁকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেন।

১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে বিসিসিআইয়ের সাথে আর্থিক মতবিরোধের জের ধরে জেরি আলেকজান্ডারের নেতৃত্বাধীন ক্যারিবীয় দলের বিপক্ষে প্রথম তিন টেস্টে অংশগ্রহণ করেননি। তবে, চতুর্থ টেস্টে তাঁকে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। বেশ ভালোমানের বোলিং করে চার উইকেট পেলেও ভারত দল ২৯৫ রানে পরাজিত হয়। হিমু অধিকারীকে চূড়ান্ত টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়।

৪১ বছর বয়সে আট নম্বর অবস্থানে ব্যাটিং করার সুযোগ পান। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯ তারিখে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম টেস্টে ৫৫ ওভার বোলিং করেন। ১৬৭ রান খরচ করলেও কোন উইকেটের সন্ধান পাননি। এছাড়াও, ব্যাট হাতে নিয়ে ২১ ও ০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালেও পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে সফরকারীরা ৩-০ ব্যবধানে জয়ী হয়। পরবর্তীতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদেয় জানান।

ভারতীয় ক্রিকেটে ফাস্ট বোলিং ও ক্ষীপ্রগতিতে বল মোকাবেলা করে কপিল দেব সমীকরণকে পরিবর্তন করার পূর্বে তাঁকে দেশের সেরা অল-রাউন্ডারের মর্যাদা দেয়া হতো। দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনে প্রকৃত মানসম্পন্ন ব্যাটসম্যান হতে পারতেন। অংশগ্রহণকৃত ৭২ ইনিংসের মধ্যে ৪০টিতে ইনিংস উদ্বোধন করতে তাঁকে দেখা যায়। ব্যাটসম্যান হিসেবে অপরিসীম ধৈর্য্য ও শক্ত রক্ষণশৈলীর পাশাপাশি প্রয়োজনে বলকে সপাটে মারতেন। কভার ড্রাইভ ও লেগ-সাইডে স্ট্রোক মারতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একই সময়ে বল মোকাবেলাকালীন প্রয়োজনে জোড়ালো আঘাত হানতেন। এছাড়াও, কভার ড্রাইভ ও লেগ অঞ্চলেও চমৎকার খেলতেন। অধিকন্তু, প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠের বহিরাংশে শূন্য স্থান বলে উঁচুতে ফেলে পাঠাতেন।

বামহাতি স্পিনার হিসেবে নিজের সেরা খেলা উপহারে সচেষ্ট ছিলেন। খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে চায়নাম্যান বোলিং করতেন। পরবর্তীতে কোচ বার্ট ওয়েনস্লি তাঁকে প্রচলিত ধাঁচের স্পিন বোলিংয়ের দিকে মনোনিবেশ ঘটান। কখনোবা প্রচলিত দ্রুতগতিসম্পন্ন স্লো-ব্রেক বোলিংয়ে সেরা ব্যাটসম্যানদের বিভ্রান্তিতে ফেলতেন। ফ্লাইট ও বাঁকানোর ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যতা আনতেন। ওভারজুড়ে একই ধরনের বোলিংয়ের মাঝখানে আকস্মিকভাবে পরাস্ত করতেন।

টেস্টগুলো থেকে ৩১.৪৭ গড়ে পাঁচ শতক সহযোগে ২১০৯ রান তুলেন। এছাড়াও, ৩২.৩২ গড়ে ১৬২ উইকেট দখল করেছিলেন তিনি। এ ধরনের পরিসংখ্যানে তাঁর সেরা হবার বিষয়টি তুলে ধরে। তিন বছর পূর্বে যদি অবসর নিতেন তাহলে এ পরিসংখ্যান আরও আকর্ষণীয় হতো। সিড গ্রিগরি ও উইলফ্রেড রোডসের সাথে তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটের সকল অবস্থানে ব্যাটিংয়ে নামার গৌরব অর্জন করেন। তিনজন ক্রিকেটারের অন্যতম হিসেবে টেস্টের সকল অবস্থানে ব্যাটিং করেছেন।

এরপর, তিনি আরও তিন বছর প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, বাংলা ও সৌরাষ্ট্রের পাশাপাশি বেশ আড়ম্বরতার সাথে বোম্বের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শেষ কয়েক মৌসুম রাজস্থানের পক্ষে খেলেন। ব্যাট ও বল হাতে নিয়ে বেশ সফল ছিলেন। অতীতের স্মরণীয় সাফল্যগুলো মাঝে-মধ্যেই হঠাৎ আলোর ঝলকানীর ন্যায় নিজেকে প্রকাশ ঘটাতেন।

অবশেষে, ১৯৬২ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটকে বিদেয় জানান। অবসর গ্রহণকালীন ৩৪.৭৮ গড়ে ১১৪৮০ রান ও ২৪.৬০ গড়ে ৭৭৪ উইকেট পেয়েছিলেন। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম তারকা ও সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। শেষবারের মতো মাঠ ত্যাগকালীনও মাঠে দর্শকদের তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত হন। এর পাঁচ বছর পর ২১ আগস্ট, ১৯৭৮ তারিখে ৬১ বছর ১৩১ দিন বয়সে তাঁর দেহাবসান ঘটে। প্রচলিত রয়েছে যে, মৃত্যুর পূর্বে শয্যায় অবস্থানকালীন সুভাষ গুপ্তে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। তাঁকে চিনতে পারার বিষয়ে ডানহাতে তুলে লেগ-স্পিন ধাঁচে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় অব্যক্ত উত্তর দিয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। অশোক মানকড় ও রাহুল মানকড় নামীয় সন্তানদ্বয়ের জনক। তাঁর সন্তান অশোক মানকড় ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে পনেরো টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। এরফলে, পিতা-পুত্রের একই দেশের পক্ষে টেস্টে অংশ নেয়ার দূর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হন।

ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর অনবদ্য ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বিসিসিআই ঘরোয়া অনূর্ধ্ব-১৯ একদিনের প্রতিযোগিতার নাম পরিবর্তন করে ‘বিনু মানকড় ট্রফি’ রাখে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের চূড়ান্ত খেলার পূর্বে ১৩ জুন, ২০২১ তারিখে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, কুমার সাঙ্গাকারা, মন্টি নোবেল, অব্রে ফকনার, লিয়ারি কনস্ট্যান্টাইন, স্ট্যান ম্যাককাবে, টেড ডেক্সটার, বব উইলিস ও ডেসমন্ড হেইন্সের সাথে তাঁকেও আইসিসি হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁর সম্মানার্থে মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ রাস্তার নামকরণ করা হয়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।