রমেশ কালুবিতরানা
২৪ নভেম্বর, ১৯৬৯ তারিখে কলম্বোয় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ও কোচ। মূলতঃ উইকেট-রক্ষক হিসেবে খেলছেন। এছাড়াও, ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। শ্রীলঙ্কার পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।
ক্ষুদ্রাকায় গড়নের অধিকারী তিনি। ‘কালু’ ডাকনামে পরিচিতি পান। সীমিত-ওভারের খেলায় ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ণে নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। এ পর্যায়ে বোলারদের উপর চড়াও হতেন, সর্বশক্তি প্রয়োগে দলের রানকে স্ফীততর করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালাতেন। মাঝারিসারির অবস্থান থেকে শীর্ষসারিতে খেলে ব্যাপকভাবে সফল হন। ছোটখাট গড়নের হলেও নির্ভীক চিত্তে ফাস্ট বোলারদের শুরুরদিকের বল মোকাবেলা করে দ্রুততার সাথে রান তুলে ইনিংসের ভিত গড়নে তৎপর ছিলেন।
১৯৮৮-৮৯ মৌসুম থেকে ২০০৪-০৫ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে কোল্টস ক্রিকেট ক্লাব, গল ক্রিকেট ক্লাব এবং সেবাস্টিয়ানিটিস ক্রিকেট ও অ্যাথলেটিক ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
১৯৯০ থেকে ২০০৪ সময়কালে শ্রীলঙ্কার পক্ষে সর্বমোট ৭৯ টেস্ট ও ১৮৯টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ৮ ডিসেম্বর, ১৯৯০ তারিখে মারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত ভারতের বিপক্ষে ওডিআইয়ে অংশ নেয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগতে প্রবেশ করেন।
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে নিজ দেশে অ্যালান বর্ডারের নেতৃত্বাধীন অজি দলের মুখোমুখি হন। ১৭ আগস্ট, ১৯৯২ তারিখে কলম্বোর এসএসসিতে অনুষ্ঠিত সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। ঐ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৩২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ক্রিকেট জগতে ঝড় তুলেন ও অভিষেক পর্বকে স্মরণীয় করে রাখেন। ঐ ইনিংসে ২৬টি বাউন্ডারি ছিল। ১৯ আগস্ট, ১৯৯২ তারিখে সংগৃহীত শতকটি শ্রীলঙ্কার তিনজন খেলোয়াড়ের অন্যতম ছিল। ফলশ্রুতিতে, কলম্বোর সিংহলীজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে সফররত অজি দলের বিপক্ষে ৫৪৭/৮ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা ১২৭ ও অশঙ্কা গুরুসিনহা’র ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেন। খেলায় তিনি তিনটি ক্যাচ তালুবন্দী করেন। তবে, দ্বিতীয় ইনিংসে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং ধ্বস নামে ও তাঁদের শেষ আট উইকেটের পতন ঘটে মাত্র ৩৭ রানে। তিনি করেছিলেন ৪ রান। গ্রেগ ম্যাথুজের অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ১৬ রানের নাটকীয় জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
তবে, শুরুতে বিশাল সফলতা লাভের পর স্ট্যাম্পের পিছনে মাঝে-মধ্যে ত্রুটির কারণে বড়দের দলে স্বীয় স্থান ধরে রাখতে পারেননি। ১৯৯৫-৯৬ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্যে মনোনীত হন। পুণরায় দলে ফিরে খেলোয়াড়ী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেন। সনথ জয়সুরিয়া’র সাথে মারমুখী উদ্বোধনী জুটি গড়ে তুলেন। এ জুটির রান সংগ্রহের হার একদিনের ব্যাটিংয়ে বিপ্লব এনে দেয়। ঐ বছরের শীতকালে শ্রীলঙ্কার বিস্ময়কর বিশ্বকাপ ক্রিকেটের শিরোপা বিজয়ে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও, স্ট্যাম্পের পিছনে অবস্থান করে আরও ক্ষীপ্রতার সাথে স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন।
তারপর থেকেই তাঁর ব্যাটিংয়ে ধরন গতিশীলতায় রূপ নেয় ও নিজেকে দীর্ঘতর ইনিংস খেলার দিকে নিয়ে যেতে তৎপর হয়ে উঠে। তবে, উদীয়মান কুমার সাঙ্গাকারা’র উত্থানে ২০০০ সালের পর থেকে তাঁর আধিপত্যে ভাগ বসাতে শুরু করেন। তাসত্ত্বেও, মাঝে-মধ্যে একদিনের আন্তর্জাতিক ও টেস্ট দলে অংশ নেয়ার সুযোগ পেতেন।
১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে অর্জুনা রানাতুঙ্গা’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের সাথে নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ৭ মার্চ, ১৯৯৭ তারিখে ডুনেডিনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ৪৩ ও ১০৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তন্মধ্যে, দ্বিতীয় ইনিংসে দলের সংগ্রহ ১২০/৫ থাকাকালে ২ রানে সায়মন ডৌল তাঁকে কট এন্ড বোল্ড করতে ব্যর্থ হন। এটি তাঁর দ্বিতীয় টেস্ট শতক ছিল। এ পর্যায়ে চামিণ্ডা ভাসের (৫৭) সাথে সপ্তম উইকেটে ১৩৮ রানের জুটি গড়ে দ্বি-পক্ষীয় নতুন রেকর্ড দাঁড় করান। এরফলে, ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে নেপিয়ারে সিআই দুনুসিংহে ও চামিণ্ডা ভাসের মধ্যকার রেকর্ড ম্লান করে দেন। তবে, ব্রায়ান ইয়ংয়ের অসাধারণ ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৩৬ রানে জয় পেয়ে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। একই সফরের ২৫ মার্চ, ১৯৯৭ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে প্রথমবারের মতো ওডিআইয়ে অংশ নেন।
১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে অর্জুনা রানাতুঙ্গা’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের অন্যতম সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ১৯ মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ১৩ ও ৪৫ রান সংগ্রহ করে উভয় ইনিংসে শন পোলকের শিকারে পরিণত হন। এছাড়াও, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে তিনটি স্ট্যাম্পিং ও দুইটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসর হন। শন পোলকের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ৭০ রানে পরাজিত হলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
একই সফরের ২৭ মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে সেঞ্চুরিয়নে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত টেস্ট খেলেন। ঘটনাবহুল এ টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ৭ রানে থাকা অবস্থায় তাঁর ক্যাচ গালি অঞ্চলে দণ্ডায়মান জিএফজে লাইবেনবার্গ মুঠোয় পুরতে ব্যর্থ হলে ব্যাট হাতে জীবন ফিরে পান। খেলায় তিনি ৯ ও ০ রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। এছাড়াও, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে একটি ক্যাচ ও সমসংখ্যক স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়ান। অ্যালান ডোনাল্ডের অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে সফরকারীরা ৬ উইকেটে পরাজয়বরণ করলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়।
১৯৯৮ সালে নিজ দেশে স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ১০ জুন, ১৯৯৮ তারিখে কলম্বোর এসএসসিতে অনুষ্ঠিত সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। চমৎকার ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শনে অগ্রসর হন। ব্যাট হাতে নিয়ে ২৮ ও ৮৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, দুইটি স্ট্যাম্পিং ও একটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ১৬৪ রানে পরাজিত হলে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। প্রসঙ্গতঃ টেস্টের ইতিহাসে পঞ্চম ঘটনা হিসেবে কোন দল প্রথম টেস্টে পরাজিত হলেও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজ জয় করে নেয়। পূর্ববর্তী চার মৌসুমে এটি চতুর্থ ঘটনা ছিল ও প্রথম দল হিসেবে শ্রীলঙ্কা দুইবার এ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। এছাড়াও, নিউজিল্যান্ড প্রথম দল হিসেবে প্রথম টেস্ট জয়ের পর তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে দুইবার পরাজয়বরণ করে।
১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে হাসান তিলকরত্নে’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের সদস্যরূপে পাকিস্তান সফরে যান। ৪ মার্চ, ১৯৯৯ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের তৃতীয় খেলায় অংশ নেন। একবার ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়ে ১০০ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ ও দুইটি স্ট্যাম্পিং ঘটানোর সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। তবে, ওয়াজাহাতুল্লাহ ওয়াস্তি’র জোড়া শতকের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালেও শ্রেয়তর রান-রেটে শ্রীলঙ্কান দল চূড়ান্ত খেলায় ভারতের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পায়।
দল নির্বাচকমণ্ডলী কুমার সাঙ্গাকারাকে টেস্টে ব্যাটিংয়ের দিকে মনোনিবেশ ঘটানোর পরামর্শ দেন ও ২০০৪ সালে টেস্টে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে, এ পর্যায়ে ব্যাট হাতে তেমন ভালো করতে পারেননি। তাসত্ত্বেও, নিজস্ব শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫৪ রান তুলেছিলেন। ২০০৪-০৫ মৌসুমে মারভান আতাপাত্তু’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের সদস্যরূপে পাকিস্তান গমন করেন। ২৮ অক্টোবর, ২০০৪ তারিখে করাচীতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে এ সাফল্য পান। এছাড়াও, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তবে, দানিশ কানেরিয়া’র অসাধারণ বোলিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৬ উইকেটে জয় পেলে সিরিজটি ড্র করতে সমর্থ হয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়েছিল।
ঐ বছরের শেষদিকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দল নির্বাচকমণ্ডলী নিউজিল্যান্ড গমনার্থে ২০-সদস্যের প্রশিক্ষণ শিবিরে তাঁকে রাখেনি। ঐদিন পরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। ১২ ডিসেম্বর, ২০০৪ তারিখে কোল্টস ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যরূপে বার্গার রিক্রিয়েশন ক্লাবের বিপক্ষে খেলেন। ২০০৪-০৫ মৌসুমের প্রিমিয়ার লীগ টুর্নামেন্টের চূড়ান্ত খেলাটি সিংহলীজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয় ও এটিই তাঁর সর্বশেষ ইনিংস ছিল। সব মিলিয়ে টেস্টগুলো থেকে ১৯৩৩ রান এবং ওডিআইয়ে ৩৭১১ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
ক্রিকেটের পর সাধারণ জীবনযাপনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। দাতব্যকর্ম ও দ্বীপরাষ্ট্রে পর্যটন আকর্ষণ পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হন। বীমা নির্বাহীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কোল্টস সিসিকেও প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। ২০০৬ সালে চীনে ক্রিকেট প্রচলনের এসিসি কমিটিতে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট কর্তৃক সদস্যরূপে মনোনীত হন। ২০০৮ সালে মালয়েশিয়ায় চলতি দায়িত্বে ছিলেন।