| |

মুদাসসর নজর

৬ এপ্রিল, ১৯৫৬ তারিখে পাঞ্জাবের লাহোরে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ও কোচ। মূলতঃ ব্যাটসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে কার্যকর মিডিয়াম বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।

টেস্টে খাঁটিমানের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ও ওডিআইয়ে দূর্দান্ত অল-রাউন্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অপরিসীম ধৈর্য্য ও ফুরফুরে মেজাজের অধিকারী থেকে খেলায় বিরাট ভূমিকা রেখে গেছেন। কার্যকর ও সফলতার সাথে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। দীর্ঘ ইনিংস খেলার কারণে পরিচিতি লাভ করেন ও পুরো খেলোয়াড়ী জীবনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস উপহার দিয়ে গেছেন।

সচরাচর তাঁকে পাকিস্তানের সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের অন্যতমরূপে গণ্য করা হয়নি। অথচ, হানিফ মোহাম্মদ ও মজিদ খানের ন্যায় উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের চেয়ে অধিক রান সংগ্রহ করে খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করেছেন। হানিফ মোহাম্মদের চেয়ে সহস্রাধিক রান বেশী তুলেছেন। শেষদিকে সাঈদ আনোয়ারের চেয়েও সেরা ছিলেন। তাসত্ত্বেও, দ্বিতীয় সেরার মর্যাদায় রয়ে গেছেন। এছাড়াও, মুদাসসর নজর ও মোহসিন খান প্রথম উইকেটে ২০৫৭ রান সংগ্রহ করেছেন। এরফলে, পাকিস্তানের ক্রিকেটের ইতিহাসে উদ্বোধনী জুটি হিসেবে সেরার মর্যাদা পান। আমির সোহেল ও সাঈদ আনোয়ার জুটির চেয়ে প্রায় ৫০০ রান এগিয়ে রয়েছেন। এ জুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পূর্বে তাঁরা সর্বকালের তালিকায় সপ্তম স্থানে অবস্থান করেছিলেন।

পাকিস্তানী টেস্ট ক্রিকেটার ও উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান নজর মোহাম্মদের সন্তান তিনি। পাঁচ বছর বয়স থেকেই পিতার সান্নিধ্যে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। দশ বছর বয়সের মধ্যেই তাঁর মাঝে ক্রিকেটীয় প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটে। ১৯৭১-৭২ মৌসুম থেকে ১৯৯৩ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর পাকিস্তানী ক্রিকেটে হাবিব ব্যাংক লিমিটেড, লাহোর, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স, পাঞ্জাব ও ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলেছেন। ১৯৭১ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। এ স্তরের ক্রিকেটে ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম আবির্ভাবেই তাঁর ফুরফুরে মেজাজ সবিশেষ লক্ষ্যণীয় ছিল।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৯ সময়কালে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বমোট ৭৬ টেস্ট ও ১২২টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। টেস্টগুলো থেকে ৩৮.০৯ গড়ে ৪১১৪ রান তুলেছেন। দশটি শতরান ও সতেরোটি অর্ধ-শতরানের ইনিংস খেলেন। তন্মধ্যে, ছয়টি শতকই ভারতের বিপক্ষে করেছেন। তাঁর প্রথম পাঁচটি সর্বোচ্চ রানের সবকটিই ছিল ভারতের বিপক্ষে। এছাড়াও, ৩৮.৩৬ গড়ে ৬৬টি উইকেট দখল করেছেন। ওডিআইয়ে ১৬টি অর্ধ-শতক সহযোগে ২৫.২৬ গড়ে ২৬৫৩ রান ও ৩০.৯১ গড়ে ১১১ উইকেট দখল করে নিজেকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছেন ও দলের অপরিহার্য্য খেলোয়াড়ে রূপান্তরিত করেছিলেন।

১৯৭০-এর দশকের শেষদিকে বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে পাকিস্তানের সফলতায় মজিদ খান ও সাদিক মোহাম্মদ স্থিরতা আনলেও তাঁদের প্রাধান্য খর্ব হতে থাকলে শীর্ষসারিতে তাঁর প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও, বোলিং করেও দলকে সহায়তার হাত প্রশস্ত করেছিলেন। এরপর থেকে দলের নিয়মিত খেলোয়াড়ে পরিণত হন। প্রায়শঃই ব্যাটিং অল-রাউন্ডার হিসেবে নিজের পরিচিতি ঘটাতেন ও দলের ভারসাম্য বজায় রাখতেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে বিশেষতঃ ওডিআইয়ে ভূমিকা রাখতেন।

ওডিআইয়েও চমৎকার অল-রাউন্ডার হিসেবে বিবেচিত হতেন। ইমরান খানের পর দ্বিতীয় পাকিস্তানী হিসেবে ২০০০ রান ও ১০০ উইকেট লাভের ন্যায় ওডিআই ‘ডাবল’ লাভ করেছেন। সব মিলিয়ে বিশ্বের পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে এ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। তাসত্ত্বেও, স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজেকে অন্যদের চেয়ে পৃথক করে রেখেছেন। ধৈর্য্যশীলতা ও ফুরফুরে মেজাজে ব্যাটিং কর্মে অগ্রসর হতেন। ১৯৮০ সালের শেষদিকে তাঁর বর্ণান্ধতার কথা জানা যায়। তিনি মন্তব্য করেছেন যে, ‘দীর্ঘাকায় গড়নের বোলারের ইয়র্কার সাইট-স্ক্রিনের সমানে এগিয়ে আসায় বল চোখে পড়তো না ও বোল্ড হয়ে যেতাম।’ সাদামাটা বোলিং করলেও মাঝে-মধ্যেই বিস্ময়করভাবে বেশ সফল হতেন।

ধীরগতিসম্পন্ন পিচে নিজের সেরা খেলা উপহার দিতেন। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে মুশতাক মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের সাথে অস্ট্রেলিয়া গমন করেন। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৬ তারিখে অ্যাডিলেডে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান সাদিক মোহাম্মদের আঘাতের কারণে খেলার সুযোগ পান। ইকবাল কাসিমের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। ইনিংস উদ্বোধনে এসে খেলায় সর্বমোট ৩৫ রান তুলতে পেরেছিলেন। ১৩ ও ২২ রান সংগ্রহ করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।

ছন্দহীন সূচনার কারণে প্রায় এক বছর দলের বাইরে ছিলেন। এরপর, ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওডিআইয়ে মুখোমুখি হন। ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭৭ তারিখে শাহিওয়ালে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওডিআইয়ে প্রথমবারের মতো অংশ নেন। ৫১ বল মোকাবেলান্তে ২০ রান তুলেছিলেন। শিয়ালকোটে অনুষ্ঠিত পরের খেলায় ৫৫ বল থেকে ৩৩ রান তুলেছিলেন।

ডিসেম্বর, ১৯৭৭ সালে লাহোরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট খেলার জন্যে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। নিজস্ব দ্বিতীয় টেস্টে রেকর্ড বহিতে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেন ও অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে টিকে আছে। দ্বিতীয় উইকেট পতনের পর হারুন রশীদ তাঁর সাথে যুক্ত হন। পাঁচ ঘণ্টায় তাঁরা ১২২ রান তুলেন। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে রান তোলার কারণে দুই দশক পূর্বে জ্যাকি ম্যাকগ্লিউ’র ৫৪৫ মিনিটে সংগৃহীত মন্থরতম শতকের রেকর্ড ভঙ্গ করে নিজের করে নেন। ৫৫৭ মিনিট ক্রিজে থেকে ৪১৯ বল মোকাবেলান্তে তিন অঙ্কের কোটা স্পর্শের মাধ্যমে নিজস্ব প্রথম শতরান করতে পেরেছিলেন। সব মিলিয়ে ৫৯১ মিনিটে ৪৪৯ বলে ১১৪ রান তুলে বিদেয় নেন। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলেও তিনি তাঁর অসম্ভব দৃঢ়তা ও প্রতিভার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী নজর কাড়েন। তবে, তাঁর এ ইনিংস মাঠে উপস্থিত ৫০,০০০ দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। ইংল্যান্ডের পেশাদার লীগে মিডিয়াম-পেস বোলিংয়ে দক্ষ হয়ে উঠেন।

১৯৮১-৮২ মৌসুমের বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে দলে বিরাট প্রভাব রেখেছিলেন। ৩১.৬৭ গড়ে ২৮৫ রান ও ১৩.৩৩ গড়ে ১২ উইকেট দখল করেছিলেন। ১৯৮২ সালে দলের সাথে ইংল্যান্ড গমন করেন। এ সিরিজের শুরুটা অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। এজবাস্টনে সিরিজের প্রথম টেস্টের উভয় ইনিংসে ইয়ান বোথামের প্রথম দুই বলে লেগ বিফোরে শূন্য রানে বিদেয় নিয়েছিলেন। খেলায় তিনি কোন উইকেটের সন্ধান পাননি। ইমরান খানের বীরোচিত অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন সত্ত্বেও খুব সহজেই পাকিস্তান দল পরাভূত হয়।

দল নির্বাচকমণ্ডলী তাঁর উপর আস্থাজ্ঞাপন করেন। আগস্ট, ১৯৮২ সালে লর্ডসে ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিয়ে মোহসিন খানের সাথে উদ্বোধনী জুটিতে ৫৩ রান তুলেন। তিনি ২০ রান সংগ্রহ করলেও মোহসিন খান ২০০ রান তুললে ইমরান খান ৪২৮/৮ তুলে ইনিংস ঘোষণা করেন। স্বাগতিক দলকে ২২৭ রানে গুটিয়ে ফলো-অনে পাঠানো হয়। বোলারদের বিশ্রাম দিতে দলের পঞ্চম বোলার হিসেবে তাঁকে বোলিংয়ের জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ডেরেক র‍্যান্ডল, অ্যালান ল্যাম্বডেভিড গাওয়ারকে বিদেয় করে ৯/৩-এ পরিণত করেন। এরপর, ইয়ান বোথাম, মাইক গ্যাটিং ও ইয়ান গ্রেগের উইকেট নিয়ে খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা বোলিং বিশ্লেষণ ১৯-৭-৩২-৬ দাঁড় করান। অনিন্দ্যসুন্দর বোলিংয়ের কল্যাণে লর্ডস অনার্স বোর্ডে নিজের জায়গা করে নেন। খুব সহজেই পাকিস্তান দল জয় পায় ও সিরিজে সমতা আসে। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং স্তম্ভ গুড়িয়ে দেয়ার কারণে ‘গোল্ডেন আর্ম’ ডাকনামে পরিচিতি পান।

তবে, হেডিংলিতে বিজয়ী হলে ইংল্যান্ড দল সিরিজ জয় করে। এ টেস্টেও নিজেকে মেলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ৬৫ রান সংগ্রহের পাশাপাশি চতুর্থ ইনিংসে ৪/৫৫ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। তাসত্ত্বেও, ২১৯ রানের জয়ে লক্ষ্যমাত্রা তিন উইকেট রেখেই পৌঁছে যায় স্বাগতিক দল।

১৯৮২-৮৩ মৌসুমে নিজ দেশে সুনীল গাভাস্কারের নেতৃত্বাধীন ভারতের বিপক্ষে খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা খেলা উপহার দেন। এ সিরিজের পূর্বেই অবশ্য ভারতের বিপক্ষে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিন বছর পূর্বে ১৯৮২ সালে ব্যাঙ্গালোরে ১২৬ রান তুলে নিজস্ব দ্বিতীয় শতক ও সর্বোচ্চ রানের সন্ধান পেয়েছিলেন।

ছয়-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পাকিস্তান ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে। জহির আব্বাসের ৬৫০ রান ও জাভেদ মিয়াঁদাদের ৫৯৪ রান সংগ্রহের পাশাপাশি ইমরান খান ১৩.৯৫ গড়ে ৪০ উইকেট দখল ও ৬১.৭৫ গড়ে ২৪৭ রান তুললেও উভয় দলের মধ্যে সিরিজে সর্বোচ্চ ৭৬১ রান তুলে স্বীয় প্রতিভার কথা জানান দেন।

লাহোরে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে ৫০ রান তুলেন। এরপর থেকেই নিজেকে সহজভাবে সম্মুখের দিকে ধাবিত করতে শুরু করেন। করাচীতে দ্বিতীয় টেস্টে মনসুর আখতারের সাথে উদ্বোধনী জুটি গড়েন। ১৯৯ বল মোকাবেলান্তে ১১৯ রান সংগ্রহ করেন। ফয়সালাবাদে আবারও ইনিংস উদ্বোধনে নামেন। ৩৮ রান সংগ্রহের পাশাপাশি দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট লাভ করেন। এবারও পাকিস্তান দল জয় পায়।

জানুয়ারি, ১৯৮৩ সালে সিন্ধুর হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত চতুর্থ টেস্টে মোহসিন খানের সাথে উদ্বোধন করতে নামেন। প্রথম বলেই বালবিন্দর সাঁধু হারুন রশীদকে বিদেয় করলে জাভেদ মিয়াঁদাদ দলের সংগ্রহ ৬০/২ থাকা অবস্থায় মাঠে নেমে তাঁর সাথে জুটি গড়েন। তাঁরা ৫১১ রান তুলে ডন ব্র্যাডম্যান ও বিল পন্সফোর্ডের গড়া বিশ্বরেকর্ডের সমকক্ষ হন। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ২৩১ রান তিনি বিদেয় নিলেও জাভেদ মিয়াঁদাদ ২৮০ রানে অপরাজিত ছিলেন। এ রান তুলতে ৬২৭ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে ৪৪৪ বল মোকাবেলা করেছিলেন। খেলায় ইনিংস ও ১১৯ রানে জয় পেয়ে পাকিস্তান দল সিরিজ বিজয় নিশ্চিত করে।

এরপরও তিনি থেমে থাকেননি। ২৩ জানুয়ারি, ১৯৮৩ তারিখে লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে সফররত ভারতের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম টেস্টে অংশ নেন। দ্বিতীয় পাকিস্তানী ব্যাটসম্যান হিসেবে ইনিংসের গোড়াপত্তন ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৫২ রানে অপরাজিত থাকেন। তাঁর ইনিংসটি ৪৯৫ মিনিটে ২৯৬ বল মোকাবেলায় ১৫টি চার ও একটি পাঁচের মারে সাজানো ছিল। এরফলে, তাঁর পিতা নজর মোহাম্মদের ৩০ বছর পূর্বে ১৯৫২-৫৩ মৌসুমে পাকিস্তানের উদ্বোধনী সিরিজে লখনউ টেস্টে ভারতের বিপক্ষে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকার ফলে প্রথম ও অদ্যাবধি পিতা-পুত্রের পূর্ণাঙ্গ ইনিংস খেলার গৌরব অর্জন করেন। এছাড়াও, ১/৩০ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।

আরও এক টেস্ট বাকী থেকে যায়। করাচীতে আরও একবার ১৫২ রান তুলেন। এরফলে, পুরো সিরিজে চার শতক সহযোগে ১২৬.৮৩ গড়ে ৭৬১ রান সংগ্রহ করেন। অন্য কোন পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানই এক সিরিজে তাঁর কাছাকাছি আসতে পারেননি। তবে, ২০০৬-০৭ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মোহাম্মদ ইউসুফ চারটি শতরানের ইনিংস খেলে এক সিরিজে তাঁর সমান হন।

খেলোয়াড়ী জীবনের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান দলের নিয়মিত সদস্যের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। এ পর্যায়ে মোহসিন খানের সাথে স্মরণীয় জুটি গড়তে তৎপরতা দেখান। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে ফয়সালাবাদ টেস্টে আরও একবার ভারতের বিপক্ষে সফলতা পান। আরও একবার ইতিহাসের পর্দায় নাম লেখান। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১৯৯ রানে বিদেয় নেন। শিবলাল যাদবের বলে সুনীল গাভাস্কার ক্যাচ তালুবন্দী করলে দ্বি-শতক হাঁকানো থেকে বঞ্চিত হন।

১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের সদস্যরূপে শ্রীলঙ্কা সফরে যান। ১৪ মার্চ, ১৯৮৬ তারিখে কলম্বোর সিসিসিতে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। ৩ ও ১ রান রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ১/৩৬ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। সিদাথ ওয়েতিমুনিকে বিদেয় করে ব্যক্তিগত ৫৭ টেস্টে ৫০তম উইকেট লাভের মাইলফলক স্পর্শ করেন। অর্জুনা রানাতুঙ্গা’র দূর্দান্ত ব্যাটিংয়ের কল্যাণে স্বাগতিকরা ৮ উইকেটে জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।

কয়েক টেস্ট পর অকল্যান্ডে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড দল ইনিংস ব্যবধানে পাকিস্তানকে পরাজিত করে। দ্বিতীয়বারের মতো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকা দোরগোড়ায় ছিলেন। ৮৯ রান তুলে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে বিদেয় হন ও দলকে ১৮৩ রানে নিয়ে যেতে বিরাট ভূমিকা রাখেন। ঐ মৌসুমের শেষদিকে মেলবোর্নে প্রবল প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওডিআইয়ে দারুণ খেলেন। ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েড ও গাস লোগি’র ন্যায় তারকা ব্যাটসম্যানদের বিদেয় করে খেলায় ৫/২৮ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। এরফলে, খুব সহজেই পাকিস্তান দল জয়লাভ করেছিল। তবে, রমিজ রাজাসেলিম মালিকের ন্যায় ব্যাটসম্যানের আবির্ভাবে দলে তাঁর অগ্রসর অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

তাসত্ত্বেও, দলে তিনি অবদান রেখে চলছিলেন। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে শারজায় অনুষ্ঠিত ওডিআইয়ে ৩/৪৪ বোলিং পরিসংখ্যান গড়াসহ ৭৪ রান তুলে পাকিস্তানের বিজয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ইমরান খানের খেলোয়াড়ী জীবন শেষদিকে চলে আসলেও তিনি তখনও দলের ভারসাম্য রাখার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। ঐ বছরের শেষদিকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছিলেন। এজবাস্টন, ওভাল ও লাহোরে অনুষ্ঠিত টেস্টগুলোয় উপর্যুপরী ১২৪, ৭৩ ও ১২০ রান করেন। এগুলোই তাঁর সর্বশেষ হাসির ফোয়ারা ছিল। তাসত্ত্বেও, পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে ঐতিহাসিক সফরে রেখেছিলেন। এরপরই তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন বিপরীতমুখী হয়ে পড়ে।

১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে ইমরান খানের অধিনায়কত্বে পাকিস্তানী দলের অন্যতম সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। দলের একমাত্র ইনিংসে ৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ০/৭ ও ২/১৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর পাশাপাশি দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তবে, জাভেদ মিয়াঁদাদের দ্বি-শতকের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালেও একটি টেস্ট পরিত্যক্ত ঘোষিত হলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়। এছাড়াও, ১৪ মার্চ, ১৯৮৯ তারিখে হ্যামিল্টনে একই দলের বিপক্ষে সর্বশেষ ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন।

ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর কোচিং জগতের দিকে ধাবিত হন। দুই মেয়াদে পাকিস্তান দলের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০০৫ সালে কেনিয়া দলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়াও, পাকিস্তানের ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমি ও নাইরোবি ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তরুণ খেলোয়াড়দের নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত হন। পরবর্তীতে, একাডেমির ক্রিকেটারদের সাথে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে দুবাইভিত্তিক আইসিসি’র গ্লোবাল ক্রিকেট একাডেমির সাথে তাঁকে যুক্ত করা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। জেহরা জানমোহামেদ নাম্নী এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেন।

Similar Posts

  • |

    শহীদ সাঈদ

    ৬ জানুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে পাঞ্জাবের লাহোরে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। পাশাপাশি, ডানহাতে মিডিয়াম বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ১৯৮০-এর দশকে পাকিস্তানের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন। ১৯৮৩-৮৪ মৌসুম থেকে ১৯৯৬-৯৭ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর পাকিস্তানী ক্রিকেটে হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন, লাহোর, পাকিস্তান…

  • |

    মৈয়াঙ্ক আগরওয়াল

    ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১ তারিখে কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালোরে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী তিনি। ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি (১.৭৫ মিটার) উচ্চতার অধিকারী। প্রণব কুমার পাণ্ডে ও সুচিত্রা সিং দম্পতির সন্তান তিনি। একই এলাকা থেকে রাহুল দ্রাবিড়ের ন্যায় তারকা খেলোয়াড়ের উত্থান ঘটলেও তাঁর…

  • | |

    জাহাঙ্গীর খান

    ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে তৎকালীন পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধরের বাস্তি গুজান এলাকায় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ও প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ বোলার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ফাস্ট-মিডিয়াম বোলিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে নিচেরসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। ১৯৩০-এর দশকে ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। দ্রুততর বোলিং করতেন ও বলে পর্যাপ্ত পেস আনয়ণে সক্ষমতা দেখিয়েছেন। মোহাম্মদ নিসার ও অমর সিংয়ের যোগ্য…

  • | |

    মন্টি নোবেল

    ২৮ জানুয়ারি, ১৮৭৩ তারিখে নিউ সাউথ ওয়েলসের ডিক্সন স্ট্রিট এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে খেলতেন। ডানহাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ডানহাতে মিডিয়াম কিংবা ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিং করতেন। অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। যোসেফ নোবেল ও মারিয়া দম্পতির অষ্টম ও কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন। ক্রাউন স্ট্রিট সুপারিয়র পাবলিক স্কুলে অধ্যয়ন করেছেন। ‘মেরি অ্যান’, ‘আল্ফ’ কিংবা…

  • |

    মধুসূদন রেগে

    ১৮ মার্চ, ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পানভেলে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ১৯৪০-এর দশকে ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৪৪-৪৫ মৌসুম থেকে ১৯৫৪-৫৫ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া পর্যায়ের ক্রিকেটে মহারাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একগুঁয়েমিপূর্ণ মনোভাব…

  • | | |

    ওয়াল্টার রবিন্স

    ৩ জুন, ১৯০৬ তারিখে স্টাফোর্ড এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে দলে ভূমিকা রাখতেন। ডানহাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ইংল্যান্ডের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। যুদ্ধের পূর্বে স্টাফোর্ডশায়ারের পক্ষে অংশগ্রহণকারী পিতা ও পরবর্তীতে ল্যাঙ্কাশায়ারের সাবেক পেশাদার ক্রিকেটার আলবার্ট নাইটের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন।…