মোহাম্মদ আশরাফুল
৭ জুলাই, ১৯৮৪ তারিখে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার। মূলতঃ মাঝারিসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক কিংবা লেগ-বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যাটসম্যান হিসেবে ধারাবাহিকতাহীন খেলা তাঁর নিত্য সঙ্গী ছিল। তাসত্ত্বেও যদি খেলোয়াড়ী জীবনের উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর দিকে আলোকপাত করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সবকিছুই গোলাপময় ছিল। ২০০০-০১ মৌসুম থেকে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রেখেছেন। মধ্যাঞ্চল, ঢাকা বিভাগ ও ঢাকা মেট্রোপলিসের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, মিনিস্টার রাজশাহী ও মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের পক্ষে খেলেছেন।
২০০১ সালে টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ শতকধারীর মর্যাদা পেয়েছেন। ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ১৫৮ রান তুলেছেন, ২০০৫ সালে কার্ডিফে তৎকালীন বিশ্বের ১ নম্বর দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মনোমুগ্ধকর শতক হাঁকিয়ে সবচেয়ে বড় ধরনের অঘটনের জন্ম দিয়েছিলেন ও ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় আশাব্যঞ্জক ৮৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।
এ সকল পরিসংখ্যানের বাইরে এলে খুব সহজেই কিছু সমর্থকের নাখোশের বিষয়টি খুব সহজেই বোঝা যাবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাটিং করে ৫০ বা তদূর্ধ্ব রান পেয়েছেন গড়পড়তা ১৫%। ব্যাটিং গড়ের সাথে রান সংগ্রহের বিষয়টি তুলনা করলে ব্যাটসম্যানের মর্যাদাপ্রাপ্ত হবেন না। এরফলে কি খুব সহজেই তিনি অমূল্যায়িত হয়ে পড়বেন? তবে, ঐ সময়ে যাদের সাথে একত্রে চলেছেন, কেবল তারাই জানেন যে শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের গুণে বলীয়ান হয়ে ও বিশাল প্রতিভার সমন্বয়ে কিভাবে সকলকে বিমোহিত করেছিলেন।
ঢাকার শহরতলী এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ধানমণ্ডিভিত্তিক একাডেমির কোচ ওয়াহিদুল গণির অধীনে প্রশিক্ষণ নিতেন। এরপর, অমরজ্যোতি ক্লাবের পক্ষে অভিষেক ঘটে। ২০০০-০১ মৌসুমের ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে তারকাসমৃদ্ধ সূর্যতরুণের পক্ষে খেলার সুযোগ পান। এ সময়েই প্রতিশ্রুতিশীল উদীয়মান তরুণ হিসেবে বাংলাদেশ দলে অন্তর্ভুক্ত হন।
২০০১ থেকে ২০১৩ সময়কালে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বমোট ৬১ টেস্ট, ১৭৭টি ওডিআই ও ২৩টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছেন। ২০০০-০১ মৌসুমে দলের সাথে জিম্বাবুয়ে গমন করেন। ১১ এপ্রিল, ২০০১ তারিখে বুলাওয়েতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওডিআইয়ে অংশ নেয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগতে প্রবেশ করেন। এরপর, ২০০১ সালে নাইমুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশী দলের সদস্যরূপে শ্রীলঙ্কা সফরে যান। ৬ সেপ্টেম্বর, ২০০১ তারিখে কলম্বোর এসএসসিতে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের দ্বিতীয় খেলায় স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। স্বাগতিক দল ইনিংস ও ১৩৭ রানের ব্যবধানে জয় পায়। ২৬ ও ১১৪ রান সংগ্রহ করে মুত্তিয়া মুরালিধরনের সাথে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
শুরুতে কিছুটা সফলতা পাবার পর ছন্দহীনতার কবলে পড়েন ও কিছু খেলায় ব্যর্থতার কারণে ২০০৩ সালে দল থেকে বাদ পড়েন। ২০০৪ সালে দলে ফিরে আসেন ও প্রত্যেককেই বিমোহিত করেন। চট্টগ্রাম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ১৫৮ রানের শতক হাঁকান। ব্যাপকভাবে আলোচিত হন ও সৌরভ গাঙ্গুলী এ ইনিংসকে অন্যতম সেরার কাতারে ফেলেন। এরপর, ওডিআইয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আরও একটি তিন অঙ্কের ইনিংস খেলেন। কার্ডিফে তাঁর এ শতকের কল্যাণে দল বিজয়ী হয়। আবারও তাঁর ব্যাটিংয়ে ছন্দপতন ঘটে ও ২০০৬ সালে দল থেকে বাদ পড়েন। আবারও তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শতরানের ইনিংস খেলেন।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার পর গণমাধ্যমে এই সূর্যসন্তানকে অধিনায়কত্ব প্রদানের প্রচারণা চালায়। তবে, এ বিষয়টি ভালো হয়নি। ২২ বছর বয়সে তাঁকে সকল স্তরের ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়। প্রথম খেলাতেই অধিনায়ক হিসেবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শতক হাঁকান। তবে, এরপর থেকেই দলের মান নিচের দিকে যেতে থাকে। নেতৃত্বসহ ব্যক্তিগত ব্যর্থতা এতে যুক্ত হয়। অবশেষে, ২০০৯ সালে অধিনায়কত্বের দায়ভার থেকে মুক্ত হন।
২০০৮ সালে অনুমোদনবিহীন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগে যুক্ত হবার কারণে দুই বছর ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার যোগ্যতা হারান। নিষিদ্ধ লীগে খেলার বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়। ২০০৯ সালের বিশ্ব টি২০ প্রতিযোগিতায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে খেলাকালীন উইকেট-রক্ষকের সাথে খোশ গল্পে মত্ত থাকতে দেখা যায়। এরফলে, মাশরাফি বিন মর্তুজা’র কাছে অধিনায়কের দায়িত্ব স্থানান্তরিত হয়। এরপর থেকে দলে নতুন মুখের আগমন ঘটতে থাকে। পরবর্তী বছরগুলোয় দলে নিয়মিতভাবে খেলার সুযোগ পাননি। তাসত্ত্বেও, মার্চ, ২০১৩ সালে গল টেস্টে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে তৎকালীন সর্বোচ্চ ১৯০ রান তুলে সকলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কুড়ান। তবে, একই দিনে দলীয় অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে তৎকালীন সর্বোচ্চ দ্বি-শতক হাঁকিয়ে রেকর্ডটি নিজের করে নেন।
২০১৩ সালে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশী দলের অন্যতম সদস্যরূপে জিম্বাবুয়ে সফরে যান। ২৫ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে হারারেতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত টেস্ট খেলেন। খেলায় তিনি উভয় ইনিংসে ৪ রান করে বিদেয় নিয়েছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ০/০ ও ১/১৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, দলীয় অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের অসাধারণ ও দায়িত্বশীল ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ১৪৩ রানে জয় পেলে সিরিজে সমতা আনতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
সবকিছুতেই সবে পরিবর্তন আসতে শুরু করা অবস্থায় আইসিসি’র দূর্নীতি বিরোধী ও নিরাপত্তা বিভাগ থেকে বিপিএলে পাতানো খেলায় সম্পৃক্ততার বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়। ২০১৩ সালে বিপিএলের দ্বিতীয় আসরে চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে $১২,৮০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে খেলা গড়াপেটায় অংশ নেন। তবে, চেকটি ফেরৎ পাঠানো হয়। ১০ দিন পর বরিশাল বার্নার্সের বিপক্ষে আবারও পাতানো খেলায় অংশ নেন। স্বীয় দোষ স্বীকার করেন ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আকসু প্রতিবেদনের আলোকে সকল স্তরের ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে কীভাবে তাকে মূল্যায়িত করা হবে তা বেশ বিতর্কের বিষয়। ২০০০ সালে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির পর ‘বিস্ময় বালক’ হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে পাতানো খেলায় জড়িত থাকার ফলে অত্যন্ত সম্ভাবনায় খেলোয়াড়ী জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।