২ নভেম্বর, ১৯৮১ তারিখে কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিল এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার। মূলতঃ বোলার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। বামহাতে ফাস্ট বোলিংয়ের পাশাপাশি বামহাতে নিচেরসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।
কিংবদন্তীতুল্য ক্রিকেটার ডেনিস লিলি ১৭ বছর বয়সী মিচেল জনসনের প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক অবগত হন ও তাঁকে সোজা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট একাডেমিতে যুক্ত করেন। এর পরপরই অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সদস্যরূপে ইংল্যান্ড গমন করেন। তবে, তাঁকে পিঠের আঘাতের সাথে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়।
‘মিজ’ কিংবা ‘নচ’ ডাকনামে ভূষিত মিচেল জনসন ৬ ফুট ২ ইঞ্চি (১.৮৯ মিটার) উচ্চতার অধিকারী। কেভিন জনসন ও ভিক্কি হার্বার দম্পতির সন্তান। ১৯৯৯ থেকে ২০০০-০১ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পক্ষে টেস্ট ও ওডিআই খেলেছেন। ২০০১-০২ মৌসুম থেকে ২০১৫ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবনে সরব ছিলেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে কুইন্সল্যান্ড ও ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, কিংস ইলাভেন পাঞ্জাব, কলকাতা নাইট রাইডার্স ও পার্থ স্কর্চার্সের পক্ষে খেলেছেন।
২০ বছর বয়সে কুইন্সল্যান্ডের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো খেলতে নামেন। তবে, পুণঃপুণঃ আঘাতের কারণে খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে তেমন ছন্দে ছিলেন না। কেবলমাত্র, ২০০৪-০৫ মৌসুমেই প্রথমবারের মতো আঘাতবিহীন মৌসুম অতিবাহিত করতে সমর্থ হন। পুরা কাপের খেলায় কুইন্সল্যান্ডের পক্ষে ৫/৪৩ লাভ করেন। এরফলে, জাতীয় দলে খেলার পথ সুগম হয়।
২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বমোট ৭৩ টেস্ট, ১৫৩টি ওডিআই ও ৩০টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। আঘাতের কবলে পড়া ব্রেট লি’র স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় ভারতের বিপক্ষে ওডিআইয়ে স্বীয় প্রতিশ্রুতিশীলতা তুলে ধরেন। ভারতের শীর্ষসারিতে ভাঙ্গন ধরান ও চার ওভারে ৪/১১ লাভ করেন। তন্মধ্যে, তারকা ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকরের উইকেট ছিল।
২০০৭-০৮ মৌসুমে নিজ দেশে মাহেলা জয়াবর্ধনে’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। ৮ নভেম্বর, ২০০৭ তারিখে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় তিনি ৯৬ রান খরচায় চার উইকেট পেয়েছিলেন। ২/৪৯ ও ২/৪৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তবে, দলের একমাত্র ইনিংসে তাঁকে ব্যাটিং করতে হয়নি। ব্রেট লি’র অসাধারণ বোলিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৪০ রানে পরাজিত হলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে। এরপূর্বে ২০০৬-০৭ মৌসুমে অ্যাশেজ সিরিজের পুরোটা সময় অস্ট্রেলিয়ার দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। বিদেশ সফরে ভারতের বিপক্ষে ওডিআই সিরিজেও দূর্দান্ত খেলেছিলেন।
২০০৮-০৯ মৌসুমে গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের মুখোমুখি হন। ১৭ ডিসেম্বর, ২০০৮ তারিখে পার্থে অনুষ্ঠিত সফররত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগতভাবে সফল ছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংসে এম মরকেলকে বিদেয় করে ব্যক্তিগত সেরা বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর পূর্বেকার সেরা ছিল ৫/৩৯। খেলায় তিনি ৮/৬১ ও ৩/৯৮ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ব্যাট হাতে নিয়ে ১৮ ও ২১ রান সংগ্রহ করে উভয় ইনিংসে মরনে মরকেলের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। এবি ডি ভিলিয়ার্সের অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে সফরকারীরা ৬ উইকেটে জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
একই মৌসুমে ফিরতি সফরে রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অজি দলের অন্যতম সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। পুরো সিরিজে অসাধারণত্বের পরিচয় দেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ তারিখে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। চমৎকার ক্রীড়া নৈপুণ্যের ছাঁপ রাখেন। অভিষেকধারী মার্কাস নর্থের (১১৭) সাথে দূর্দান্ত জুটি গড়েন। খেলায় তিনি ৯৬* ও ১ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ৪/২৫ ও ৪/১১২ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর অনবদ্য অল-রাউন্ড কৃতিত্বে স্বাগতিকরা ১৬২ রানে পরাভূত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
একই সফরের ১৯ মার্চ, ২০০৯ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। কয়েকবার ব্যক্তিগত সাফল্যের সন্ধান পান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ৯৬ রান অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে টেস্টে নিজস্ব প্রথম শতক হাঁকান। খেলায় তিনি ৩৫ ও ১২৩* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ৪/১৪৮ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, পল হ্যারিসের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ২০ রানে জয়লাভ করলেও ২-১ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়। এ সিরিজে ২৫৫ রান সংগ্রহসহ ১৬ উইকেট দখল করে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৯-১০ মৌসুমে রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ১৯ মার্চ, ২০১০ তারিখে ওয়েলিংটনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ১/৩৮ ও ১/১০৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ব্যাট হাতে নিয়ে কোন ইনিংসেই তাঁকে মাঠে নামতে হয়নি। তবে, মাইকেল ক্লার্কের ব্যাটিং বদান্যতায় স্বাগতিকরা ১০ উইকেটে পরাজিত হলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
একই সফরের ২৭ মার্চ, ২০১০ তারিখে হ্যামিল্টনে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে টিজি ম্যাকিন্টোশের প্রথম উইকেট লাভ করে টেস্টে ১৫০ উইকেট লাভের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ৪/৫৯ ও ৬/৭৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, উভয় ইনিংসে ড্যানিয়েল ভেট্টোরি’র বলে শূন্য রানে বিদেয় নেন। তাঁর অনবদ্য বোলিং নৈপুণ্যে সফরকারীরা ১৭৬ রানে জয়লাভ করলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৩-১৪ মৌসুমে মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ তারিখে সেঞ্চুরিয়নে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনে অগ্রসর হন ও ব্যক্তিগত সফলতার ছাঁপ রাখেন। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে এএন পিটারসনের প্রথম উইকেট লাভ করে টেস্টে ২৫০ উইকেট লাভের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ৭/৬৮ ও ৫/৫৯ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, একবার ব্যাট হাতে নিয়ে ৩৩ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তাঁর অনবদ্য বোলিং কৃতিত্বে সফরকারীরা ২৮১ রানে জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৫-১৬ মৌসুমে নিজ দেশে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ তারিখে পার্থে অনুষ্ঠিত সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ১/১৫৭ ও ২/২০ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ২ ও ২৯ রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেন। রস টেলরের অসাধারণ ব্যাটিং সাফল্যে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে স্বাগতিকরা ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
২০০৯ সালে আইসিসি বর্ষসেরা খেলোয়াড় হিসেবে পুরস্কার পান। এছাড়াও, ২০১৪ সালে আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার, বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার ও বর্ষসেরা টেস্ট খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করেন। ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর থেকেই মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। জেসিকা ব্রাটিচ নাম্নী এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেন। এ দম্পতির রুবিকা অ্যান জনসন নাম্নী কন্যা ও লিও ম্যাক্স জনসন নামীয় পুত্র রয়েছে।
