মিসবাহ-উল-হক
২৮ মে, ১৯৭৪ তারিখে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও প্রশাসক। মাঝারিসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী। পাকিস্তানের পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি, পাকিস্তান দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাকিস্তানের সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের মর্যাদা লাভসহ সর্বাপেক্ষা সফল টেস্ট অধিনায়কের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছেন। ওয়াসিম আকরামকে পাশ কাটিয়ে ওডিআইয়ে কোনরূপ শতক হাঁকানো ব্যতিরেকে সর্বাধিকসংখ্যক রান সংগ্রহের অধিকারী।
প্রতিকূল পরিবেশে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। খুব কমই তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। একবার দ্য ক্রিকেট মান্থলিতে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘পাকিস্তানের পক্ষে ক্রিকেট খেলার সুযোগ লাভের পরিবেশ যতটা সহজ ভাবা হয়, আসলে তা নয়। মিয়ানওয়ালিও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে, সেরা ক্রিকেটারদের আবির্ভাবও কোন অংশে কম নয়। পাকিস্তানের পক্ষে খেলার সম্ভাবনা বাদ দিলেও প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটারের স্বীকৃতি পাওয়াও বেশ কষ্টকর। সেখানে এটি নিছক মজা লাভের উদ্দেশ্যে খেলা হয়। খেলা হয় শুধুমাত্র নিজের আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে।’
১৯৯৮-৯৯ মৌসুম থেকে ২০১৮-১৯ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর পাকিস্তানী ক্রিকেটে খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ ও সারগোদার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, ফয়সালাবাদ উল্ভস, ইসলামাবাদ ইউনাইটেড, পেশাওয়ার জালমি, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ও সেন্ট লুসিয়া জুকসের পক্ষে খেলেছেন।
১৯৯৮ সালে ২৪ বছর বয়সে সারগোদার পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। তিন বছর পর ২০০১ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে দূর্দান্ত খেলে জাতীয় দল নির্বাচকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। কিন্তু তেমন সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি।
খেলোয়াড়ী জীবনে অনেকগুলো ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পিএসএলের প্রথম আসরে ইসলামাবাদ ইউনাইটেডের শিরোপা জয়ে নেতৃত্ব দেন। ফয়সালাবাদ উল্ভস ও এসএনজিপিএলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। এ সময়ে অনেকগুলো প্রতিযোগিতার শিরোপা বিজয়ে ভূমিকা রাখেন। তন্মধ্যে, ২০১২-১৩ মৌসুমে দূর্দান্ত খেলেন। ফয়সালাবাদ উল্ভসকে নেতৃত্ব দিয়ে টি২০ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা লাভ করে। এরফলে, দলটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ টি২০ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এছাড়াও, ঐ মৌসুমে টি২০, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট ও লিস্ট-এ ক্রিকেটের সবগুলো প্রতিযোগিতায় দলটির নেতৃত্বে ছিলেন। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের উদ্বোধনী আসরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর দলের পক্ষেও খেলেছেন তিনি। ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কা প্রিমিয়ার লীগে কন্দুরাতা ওয়ারিয়র্সের পক্ষে খেলেন। এরপর, ক্যারিবীয় প্রিমিয়ার লীগে সেন্ট লুসিয়া জুকস ও বার্বাডোস ট্রাইডেন্টসের সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালে বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের পক্ষে খেলার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন।
২০০১ থেকে ২০১৭ সময়কালে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বমোট ৭৫ টেস্ট, ১৬২টি ওডিআই ও ৩৯টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছেন। ২০০০-০১ মৌসুমে মঈন খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের সাথে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ২৭ বছর বয়সে ৮ মার্চ, ২০০১ তারিখে অকল্যান্ডে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ফয়সাল ইকবাল, ইমরান ফারহাত ও মোহাম্মদ সামি’র সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক ঘটে। প্রথম ইনিংসে দুই ঘণ্টারও অধিক সময় নিয়ে মাত্র ২৮ রান তুলে মাঝারিসারিতে তাঁর অবস্থান মজবুতকরণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ১০ রান তুলেছিলেন। তবে, অপর অভিষেকধারী মোহাম্মদ সামি’র অসামান্য বোলিংশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ২৯৯ রানে জয় পেয়ে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
২৭ এপ্রিল, ২০০২ তারিখে লাহোরে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে তিনি প্রথমবারের মতো ওডিআইয়ে অংশ নেন। তবে, এ সময়ে খুব কমই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। খেলায় ছন্দ না থাকায় দলের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন। নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত ত্রি-দেশীয় সিরিজে বেশ ভালো খেলেন। তবে, এর পরপরই খেলায় ছন্দ হারালে জাতীয় দলের বাইরে চলে যেতে হয়। এরপর থেকে নিখুঁত মানসম্পন্ন ব্যাটিংয়ে সকলের নজর কাড়েন। দলের প্রয়োজনে বড় ধরনের মারেও অভ্যস্ত তিনি। মূলতঃ শুরুরদিকের সময়গুলোয় তাঁর মন্দ সময় প্রবাহিত হয়।
২০০১ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে খুব কম খেলার সুযোগ পান। এ পর্যায়ে তিনি দল নির্বাচকমণ্ডলীর আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হন। এরপর তাঁকে লম্বা সময় প্রতিক্ষার প্রহর গুণতে হয়েছিল। তাঁর সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তিনি নিস্তেজ অবস্থায় খেলতেন। এ বিষয়টি তাঁর ব্যাটিংয়ে লক্ষ্য করা যায়। ২০১১ সালে তাঁর খেলার মান বেশ নিচেরদিকে চলে গিয়েছিল। অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করে ২০১০ সালে খেলা গড়াপেটার অমোচনীয় কালি থেকে পাকিস্তানকে উত্তরণের দিকে নিয়ে যান। ৩৬ বছর বয়সে দলকে পরিচালনা করার সুযোগ পান। বেশ স্থিরচিত্তে পাকিস্তান ক্রিকেটের চাহিদামাফিক টালমাটাল সময়কে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে থাকেন।
২০১০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অনুষ্ঠিত টেস্ট সিরিজে দলকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়। খুব শীঘ্রই সীমিত-ওভারের খেলায় অধিনায়ক হিসেবে অবসর নেয়া শহীদ আফ্রিদি’র স্থলাভিষিক্ত হন। তবে, সাবেক ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সমালোচিত হলে টি২০আই থেকে নেতৃত্ব প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তাসত্ত্বেও, দীর্ঘ সংস্করণের খেলায় অধিনায়কত্ব বহাল রাখা হয়। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৮৮ সালের পর ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো টেস্ট ক্রিকেটে পাকিস্তান দল ১ নম্বর অবস্থানে পৌঁছে। পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা সফল টেস্ট অধিনায়কের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। ২৬ টেস্ট জয়ে নেতৃত্ব দেন; ইমরান খানের ১৩ টেস্ট জয়ের সাথে তুলনান্তে দ্বিগুণ।
ব্যাটসম্যান হিসেবে অপরিসীম ধৈর্য্যশক্তির পরিচয় দিতেন। এরফলে, তিনি তাঁর রক্ষণশীল কৌশলের ভিতকে আরও মজবুত করতে পেরেছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাট হাতে নিয়ে অবস্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এরপর আরও অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় অংশ নিলেও ধারাবাহিকতা ছিল না। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে চার বছর তিনি কোন টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। তবে, কয়েকটি ওডিআইয়ে অংশ নিতে পেরেছিলেন।
২০০৭ সালে আবারও জাতীয় দলে ফিরে আসেন ও তাৎক্ষণিক সফলতা পান। ঘরোয়া আসরের ক্রিকেটে নিয়মিত রান সংগ্রহের পাশাপাশি ইংল্যান্ডের ক্লাব ক্রিকেটে সাফল্য লাভ ও ওডিআই থেকে ইনজামাম-উল-হকের অবসর গ্রহণের পর জুলাই, ২০০৭ সালে তাঁকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে চুক্তিতে আবদ্ধ করা হয়। এক মাস পর বিস্ময়করভাবে মোহাম্মদ ইউসুফকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত টি২০ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপে ১৫-সদস্যের পাকিস্তান দলে তাঁকে রাখা হয়। দল নির্বাচকমণ্ডলীর আস্থা কুড়ান। প্রতিযোগিতায় তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করেন ও পাকিস্তানের সেরা খেলোয়াড়ে পরিণত হন। চূড়ান্ত খেলায় দলকে প্রায় বিজয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম পাকিস্তানী হিসেবে এ স্তরের ক্রিকেটে বিশ্বের ১ নম্বর খেলোয়াড় হন ও অর্ধ-শতক করেন। ঐ বছরের শেষদিকে ভারত সফরেও রান সংগ্রহের ফল্গুধারা প্রবাহিত রাখেন। দুইটি শতক হাঁকান। প্রত্যেকটিতেই চার শতাধিক মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন। তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ৪৬৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
২০০৭ সালের আইসিসি বিশ্ব টি২০ প্রতিযোগিতায় বেশ সুনাম কুড়ান। পাকিস্তানের শীর্ষ রান সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন। দুইবার ভারতের বিপক্ষে দলকে জয়ের কাছাকাছি পর্যায়ে নিয়ে আসলেও উভয়ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়। টেস্টেও ভারতের বিপক্ষে বেশ সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। দুইটি শতক ও একটি অর্ধ-শতক সহযোগে ১১৬ গড়ে রান পেয়েছেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে ভারতের কাছে পরাজিত হলেও ৭৬ রান তুলে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন।
দলের স্থায়ী সদস্যের মর্যাদা পান। ২০০৯ সালের টি২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের শিরোপা বিজয়ে বেশ ভালো করেন। ২০১১ সালে নিজের স্বর্ণালী সময় অতিবাহিত করেন ও শীর্ষসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দলের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত করেন।
২০১১ সালের আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় সহঃ অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। আটটি খেলায় অংশ নেন। অপরাজিত ৮৩ রানের ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দলের ১১ রানের বিজয়ে বিরাট ভূমিকা রাখেন। এরপর, ২০১৫ সালের প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের একদিনের আন্তর্জাতিকের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে দলকে নেতৃত্ব দেন ও ঐ প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন।
খেলায় স্বাধীনতা না থাকায় মুক্তভাবে কখনো ওডিআইয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারেননি। ধ্বংসপ্রবণ মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যাটিং অবস্থান নিয়ে গড়া দলের সদস্যরূপে নিজেকে গুটিয়ে খেলতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে, দলীয় সঙ্গীদের চেয়ে স্ট্রাইক রেটে খুব কম সময়ই নিজেকে শীর্ষে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তবে, গড়ের দিক দিয়ে বেশ এগিয়েছিলেন। খুব কমই তাঁর খেলার ধরনে নেতিবাচক মনোবৃত্তি লক্ষ্য করা গেছে। কেবলমাত্র অনেকগুলো বছর ধীরলয়ে রান তোলার কারণে টুক টুক স্তরে নিজের পরিচিতি ঘটান। ক্রিজে তাঁর রক্ষণাত্মক ভঙ্গীমায় ব্যাটিংয়ের কারণে ‘টুক-টুক’ বা ‘ব্লক-ব্লক’ ডাকনামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। তবে, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৭৬ বল মোকাবেলায় ৫৬ রানের অর্ধ-শতরানটি ব্যতিক্রম ছিল।
টুক টুক খোলস থেকে ব্যাং ব্যাংয়ে পরিণত হন। ২০১৪-১৫ মৌসুমে পাকিস্তানী দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত গমন করেন। ৩ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়াশৈলীর স্বাক্ষর রাখেন। এ টেস্টের একই ইনিংসে দ্রুততম অর্ধ-শতক ও শতক হাঁকান। মাত্র ২১ বলে অর্ধ-শতরান করার পর ৫৬ বলে শতক হাঁকান। ঐ সময়ে এটি দ্রুততম শতক ছিল। অবসর গ্রহণকালীন টেস্টে ভিভিয়ান রিচার্ডসের সাথে যৌথভাবে দ্বিতীয় দ্রুততম টেস্ট শতক হাঁকানোর রেকর্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তানের পঞ্চম অধিনায়ক হিসেবে হানিফ মোহাম্মদ, ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ ও সাঈদ আনোয়ারের পর উইজডেন কর্তৃক বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। এছাড়াও, ঐ টেস্টে ১০১ ও অপরাজিত ১০১ রান তুলেন। এরফলে, মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে একইসংখ্যক রান তুলেন। তাঁর জোড়া শতকের সুবাদে পাকিস্তান দল ৩৫৬ রানে জয় তুলে নিলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
এর দেড় বছর পর ২০১৬ সালে পাকিস্তান দলের নেতৃত্বে থেকে ইংল্যান্ড গমন করেন। পুরো সিরিজে অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনে অগ্রসর হন। লর্ডসে স্বাগতিক দলের বিপক্ষে মনোমুগ্ধকর ১১৪ রান তুলেন। এরফলে, ৪২ ঊর্ধ্ব বয়সে বয়োজ্যেষ্ঠ টেস্ট শতকধারীর মর্যাদা লাভসহ বয়োজ্যেষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে শতক হাঁকানোর কৃতিত্বের অধিকারী হন। ঐ টেস্টে তাঁর দল জয়লাভ করে। এটিই ইংল্যান্ডে তাঁর প্রথম টেস্টে অংশগ্রহণ ছিল। দশম শতক হাঁকানোয় প্যাভিলিয়নে অবস্থানরত দলীয় সঙ্গীরা আনন্দ উদযাপন করে।
১১ আগস্ট, ২০১৬ তারিখে ওভালে স্বাগতিক ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে অংশ নেন। একবার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ১৫ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তবে, ইউনুস খানের দূর্দান্ত ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ১০ উইকেটে পরাজিত হলে ২-২ ব্যবধানে অমিমাংসিত অবস্থায় সিরিজটি শেষ হয়। ২৮২ রান সংগ্রহ করে ক্রিস উকসের সাথে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার পান।
এ সফরের পূর্বে দলের শারীরিক অনুশীলনের অংশ হিসেবে অ্যাবোটাবাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে একত্রে অনুশীলন করে। উপর্যুপরী দশমবার টসে জয়লাভ করে পাকিস্তান দল ব্যাট হাতে প্রথমে মাঠে নামে ও দলের সংগ্রহ ৭৭/৩ থাকা অবস্থায় দলের হাল ধরেন। ইউনুস খানের সাথে ৫৭ ও আসাদ শফিকের (৭৩) সাথে পঞ্চম উইকেটে ১৪৮ রানের জুটি গড়েন। ঐ সিরিজটি ২-২ ব্যবধানে ড্রয়ে পরিণত হয়। এ ফলাফলে পাকিস্তান দল আইসিসি’র টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে পৌঁছে যায়। উল্লেখযোগ্য বোলিং আক্রমণ ও নির্ভরযোগ্য উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানদের ছাড়াই এ সফলতা লাভ করেন। দলের প্রধান তারকা বোলার সাঈদ আজমল বল ছুঁড়ে মারার কারণে অভিযুক্ত ছিলেন।
অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে যথেষ্ট সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। পাকিস্তানী অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে সর্বাধিক রান, ওডিআইয়ে ইমরান খানের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রান ও একটি বিশ্বকাপে সর্বাধিক রান সংগ্রহ করেছেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে টেস্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালনকালে ৩৬ খেলা থেকে ৫৮.৭৩ গড়ে ২৮৭৮ রান তুলে ইমরান খান, ইনজামাম-উল-হক ও জাভেদ মিয়াঁদাদের তুলনায় নিজেকে অনেক এগিয়ে রাখেন। প্রথম পাকিস্তানী অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও, নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মাটিতেও সিরিজ বিজয়ে পাকিস্তান দলকে পরিচালনা করেন।
দলের নেতৃত্ব গ্রহণকালে কোন জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় ছিল না ও খেলা গড়াপেটার গ্লানি থেকে উত্তরণের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন। দলের ফলাফল অনুকূলে নিয়ে যেতে থাকেন। পাশাপাশি, মাঝারিসারিতে ইউনুস খানের সাথে দায়ভার নিয়ে দলের ভিত মজবুতকরণে এগিয়ে নিয়ে যান। ভারত সফরে রান সংগ্রহের পাশাপাশি ঠাণ্ডা মেজাজে ও শান্ত ভঙ্গীমায় খেলা উপহার দিয়ে সকলের নজর কাড়েন। খুব শীঘ্রই ইনজামাম-উল-হকের যোগ্য উত্তরসূরী ও ভবিষ্যতের অধিনায়কের দাবীদারে পরিণত হন। ২০০৮ সালে তাঁকে পাকিস্তানের সহঃ অধিনায়কের মর্যাদা দেয়া হয় ও প্রথম স্তরের চুক্তিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, আকস্মিকভাবে খেলায় ছন্দপতন ঘটলে তিন স্তরের ক্রিকেটের সবকটি থেকে বাদ দেয়া হয়। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডে দলের শোচনীয় ফলাফলের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন না। ঐ বছরের শেষদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
প্রোটীয়দের বিপক্ষে ফলাফলবিহীন অবস্থায় সিরিজ ড্র হয়। এরপর, ২০১১ সালের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরে পাকিস্তানের ১-০ ব্যবধানে সিরিজ বিজয়ে অংশ নেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে পরাজিত হওয়া খেলায় মন্থর ব্যাটিং করে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। তবে, ঐ সকল সমালোচনার কোন উত্তর দেননি। ২০১২ সালে ওডিআই অধিনায়কত্ব করা থেকে শহীদ আফ্রিদিকে বাদ দেয়া হলে তাঁকে পাকিস্তান দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত করা হয়। ২০১২ সালের শুরুতে তৎকালীন বিশ্বের এক নম্বর দল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ে দলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওডিআইয়ে সিরিজ হারালে তাঁকে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তবে, পিসিবি কর্তৃপক্ষ পুণরায় তাঁকে এ দায়িত্বে বহাল রাখে ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা পর্যন্ত অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করে। এর পরপরই দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরতি সফরে প্রোটীয়দের বিপক্ষে পাল্টা প্রতিশোধ নেয়। ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয়ের মাধ্যমে উপমহাদেশের প্রথম দল হিসেবে দ্বি-পক্ষীয় সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায়। দেশব্যাপী তাঁর গুণগানে মেতে উঠে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও তাদের সাফল্যের পুণরাবৃত্তি ঘটায়। ওডিআইয়ে খুব সহজে জয় পেলেও টেস্ট সিরিজটি ১-১ ব্যবধানে ড্রয়ে পরিণত হয়। তন্মধ্যে, তৃতীয় টেস্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১৩ সালে অসাধারণ খেলেন। এক পঞ্জিকাবর্ষে সহস্রাধিক রান তুলেন।
২৩ সিরিজের ১১টিতে তাঁর দল জয় পান, ৭টি সিরিজ ড্র করে ও ৫টি সিরিজে পরাজিত হয়। এছাড়াও, ২৬ টেস্টে দলের জয়ে নেতৃত্বে ছিলেন। নিকটতম অন্য কোন পাকিস্তানী অধিনায়ক ১৫ টেস্ট বিজয় স্পর্শের সৌভাগ্য লাভ না করলেও পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট আয়োজনের সুযোগ না থাকায় সবগুলো জয়ই বিদেশের মাটিতে সম্পন্ন করেছেন। ২০১৫ সালের আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ৩১৬ রান তুলে ইমরান খানের ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় সংগৃহীত রানের রেকর্ড নিজের করে নেন।
বিএসসি ডিগ্রীসহ লাহোর ম্যানেজম্যান্ট এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তরধারী তিনি। এরফলে, দলের পরিচালনা ব্যাপক সহায়তা করে ও দলকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল। চল্লিশ বছর বয়সেও প্রতিপক্ষীয় দলের কাছে সর্বাপেক্ষা বিপজ্জ্বনক খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছিলেন। জানুয়ারি, ২০১৫ সালে ঘোষণা করেন যে, ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শেষে ওডিআই ও টি২০আই থেকে অবসর গ্রহণ করবেন।
২০১৭ সালে অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে পাকিস্তানী দলকে নিয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ গমন করেন। ৪৩ বছর বয়সে ১০ মে, ২০১৭ তারিখে রোজিওতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। পরবর্তীতে, এটি তাঁর সর্বশেষ টেস্টে অংশগ্রহণ ছিল। অধিকাংশ দেশের পক্ষেই এ বয়সটি বেশ বড় ধরনের; আর পাকিস্তানের পক্ষেতো তা একেবারেই অচিন্ত্যনীয়। ঐ খেলার পর ইউনুস খানের সাথে তিনিও একযোগে অবসর গ্রহণ করেন। ৫৯ ও ২ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। ঐ টেস্টে রোস্টন চেজের অসামান্য অল-রাউন্ড ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন স্বত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে তাঁর দল ১০১ রানে বিজয়ী হয়েছিল ও ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়।
অমর্যাদাকর রেকর্ডের সাথেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। ওডিআইয়ে সর্বাধিক রান ও সর্বাধিক অর্ধ-শতক হাঁকালেও তিন অঙ্কের কোটা স্পর্শ করতে পারেননি তিনি। ৪৩.৩০ গড়ে ৫১২২ রান করেছেন। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ করেছেন অপরাজিত ৯৬ রান। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শেষে ওডিআই থেকে অবসরগ্রহণকালীন কোনরূপ শতরানের ইনিংস খেলতে পারেননি। তবে, উৎসাহব্যঞ্জক রেকর্ড গড়েছেন। ২০১৩ সালে এক পঞ্জিকাবর্ষে ওডিআইয়ে সর্বোচ্চ ১৫টি অর্ধ-শতক হাঁকিয়েছেন। ২০১২-১৩ মৌসুমে ভারতের বিপক্ষে ওডিআই সিরিজ জয়ে দলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ওডিআই সিরিজ জয়ে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি ২০১২ সালের এশিয়া কাপের শিরোপা বিজয়ী পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ছিলেন। এছাড়াও, একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে তিনবার ৯৯ রানের ইনিংস খেলেছেন।
৪৬.৬২ গড়ে টেস্টে রান তুললেও তা অসাধারণ পর্যায়ের নয়। তবে, কেউ যদি বয়সের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, মোট রানের মধ্যে ২০০৪ রান যা প্রায় ৪০% করেছেন চল্লিশের বয়সে। কেবলমাত্র জ্যাক হবস তাঁর তুলনায় এগিয়ে আছেন ও অন্য কেউ এর এক-চতুর্থাংশ রানও সংগ্রহ করতে পারেননি। পাকিস্তানী অধিনায়ক হিসেবে সর্বাধিক আটটি শতক হাঁকিয়েছেন ও ৪২১৪ রান তুলেছেন।
টি২০আই খেলোয়াড়ী জীবনে কেবলমাত্র ২০০৭ বিশ্ব টি২০ প্রতিযোগিতায় ভারতের বিপক্ষে দুই খেলায় নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। এর বাইরে তাঁর টি২০ খেলোয়াড়ী জীবনে তেমন সফলতা পাননি। সকল ধরনের সফলতা লাভ সত্ত্বেও মাঝে-মধ্যেই মোহাম্মদ ইউসুফ থেকে শোয়েব আখতারের ন্যায় তারকা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কঠোরভাবে সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি তালিবান বিষয়ে বক্তব্যের কারণে সহানুভূতিসম্পন্ন খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এ সকল সত্ত্বেও ১৯৮০-এর দশকের শেষদিকের সাফল্যের সাথে পাকিস্তান দলকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। অধিকাংশ ক্রিকেটারই ত্রিশের মাঝামাঝি সময়ে খেলোয়াড়ী জীবনের সমাপ্তি টানলেও তিনি এর ব্যতিক্রম ছিলেন। ৩৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুণরায় ফিরে আসেন ও ৩৬ বছর বয়সে পাকিস্তান দলের অধিনায়কের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। ৪১ বছর বয়সে এসেও ওডিআইয়ে সক্রিয় ছিলেন। অবশেষে, ২০১৭ সালে ৪৩ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদেয় জানান। ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর ক্রিকেট প্রশাসনের সাথে যুক্ত হন। জাতীয় দল নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৪ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে লাহোরে এ দায়িত্ব থেকে তাঁর অব্যাহতি নেয়ার বিষয়ে বক্তব্য দেন।