২ এপ্রিল, ১৯৮১ তারিখে নিউ সাউথ ওয়েলসের লিভারপুল এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার। মূলতঃ মাঝারিসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সকল স্তরের ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন ও দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
লেস ক্লার্ক ও ডেবি ক্লার্ক দম্পতির সন্তান। ‘পাপ’ কিংবা ‘ক্লার্কি’ ডাকনামে ভূষিত মাইকেল ক্লার্ক ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি (১.৭৮ মিটার) উচ্চতার অধিকারী। ১৯৯৯-২০০০ মৌসুম থেকে ২০১৫-১৬ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলস ও ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে হ্যাম্পশায়ারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, পুনে ওয়ারিয়র্সের পক্ষে খেলেছেন।
২০০৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বমোট ১১৫ টেস্ট, ২৪৫টি ওডিআই ও ৩৪টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯ জানুয়ারি, ২০০৩ তারিখে অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওডিআইয়ে অংশ নেয়ার মাধ্যমে বর্ণাঢ্যময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগতে প্রবেশ করেন। ২০০৪-০৫ মৌসুমে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সাথে ভারত সফরে যান। ৬ অক্টোবর, ২০০৪ তারিখে ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। প্রথম ইনিংসে ২৪৮ বল মোকাবেলান্তে মনোমুগ্ধকর ১৫১ রানের ইনিংস খেলেন। এছাড়াও, দ্বিতীয় ইনিংসে ১৭ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, ০/৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। ঐ খেলায় তাঁর দল ২১৭ রানে জয় পেয়ে চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
সায়মন জোন্সের করা ‘শতাব্দীর সেরা’ একাদশ বল মোকাবেলা করেছিলেন। এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকেরা তাঁকে স্তরভিত্তিক ক্রিকেটে ফিরে যেতে ব্যানারে লেখা প্রদর্শন করে। কিছুকাল খেলার জগৎ থেকে দূরে থাকার পর ওয়েস্টার্ন সাবার্বসের পক্ষে খেলে ৪৮ রান তুলেন।
২০০৯-১০ মৌসুমে রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অজি দলের অন্যতম সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ১৯ মার্চ, ২০১০ তারিখে ওয়েলিংটনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক কিউই দলের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। চমৎকার ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে নিজেকে জড়ান। প্রথম ইনিংসে ১৬৬ রানে পৌঁছানোকালে পূর্বতন সর্বোচ্চ রান অতিক্রম করেন। একবার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ১৬৮ রানের ইনিংস খেলেন। এছাড়াও, দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ১০ উইকেটে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
২০১১ সালে অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে অজি দলকে নিয়ে শ্রীলঙ্কা গমন করেন। ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১১ তারিখে কলম্বোর এসএসসিতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কসূলভ ১১৮ ও ৯৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও সফরকারীরা ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়। তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, এ সিরিজে ৪৬৩ রান সংগ্রহসহ দুই উইকেট দখল করে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার পান।
২০১১-১২ মৌসুমে অজি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ৯ নভেম্বর, ২০১১ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ৪৪ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৫০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ১৫১ ও ২ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। অভিষেকধারী ভার্নন ফিল্যান্ডারের অসাধারণ বোলিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৮ উইকেটে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
একই সফরের ১৭ নভেম্বর, ২০১১ তারিখে জোহানেসবার্গের নিউ ওয়ান্ডারার্সে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ১১ ও ২ রান সংগ্রহসহ তিনটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ২/৬ ও ০/২ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, প্যাট কামিন্সের সুন্দর ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনের সুবাদে সফরকারীরা ২ উইকেটে জয় পেয়ে সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ করতে সক্ষম হয়।
২০১২-১৩ মৌসুমে নিজ দেশে গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের মুখোমুখি হন। পুরো সিরিজে অসাধারণত্বের পরিচয় দেন। ৯ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত সফররত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ২৫৯* রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, ০/৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর অসাধারণ দ্বি-শতক সত্ত্বেও খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
এরপর, ২২ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে ব্যক্তিগতভাবে সফল ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ১৪৪ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৬৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ২৩০ ও ৩৮ রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, ১/২২ ও ০/৩৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, ফাফ ডু প্লিসি’র অসাধারণ ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
একই সফরের ৩০ নভেম্বর, ২০১২ তারিখে পার্থে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে খেলায় তিনি ৫ ও ৪৪ রান সংগ্রহসহ তিনটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। হাশিম আমলা’র অনবদ্য ব্যাটিং সাফল্যে স্বাগতিকরা ৩০৯ রানে পরাজিত হলে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়। এ সিরিজে ৫৭৬ রান সংগ্রহসহ একটি উইকেট লাভ করে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার লাভ করেন।
একই মৌসুমে নিজ দেশে মাহেলা জয়াবর্ধনে’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। পুরো সিরিজে অসাধারণত্বের পরিচয় দেন। ৩ জানুয়ারি, ২০১৩ তারিখে সিডনির এসসিজিতে অনুষ্ঠিত সফররত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে ৫০ ও ২৯ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তবে, জ্যাকসন বার্ডের অনবদ্য বোলিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৫ উইকেটে জয় তুলে নেয়ার পাশাপাশি ৩-০ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়। এ সিরিজে ৩১৬ রান সংগ্রহ করে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার লাভ করেন।
২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শেষে ওডিআই থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ঐ প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়া দলের শিরোপা বিজয়ে দলনেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানরূপে চিত্রিত হয়ে আসছেন। ব্যতিক্রমী অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিতেন ও বেশ কিছু দারুণ জয়ে ভূমিকা রাখেন।
এরপর, ২০১৫ সালের অ্যাশেজ সিরিজ শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগৎকে বিদেয় জানান। ঐ বছর দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ইংল্যান্ড সফরে যান। ২০ আগস্ট, ২০১৫ তারিখে ওভালে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার খেলায় অংশ নেয়ার মাধ্যমে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবনের সমাপণ ঘটান। লন্ডনের ওভালে অনুষ্ঠিত ৫ম ইনভেস্টেক টেস্টে দলের একমাত্র ইনিংসে ১৫ রান সংগ্রহসহ তিনটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৪৬ রানে পরাভূত হলেও পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে বিজয়ী হয়।
টেস্টগুলো থেকে ২৮ শতক সহযোগে ৪৯.১০ গড়ে ৮৬৪৩ রান তুলেছিলেন। এছাড়াও, ২৯ মার্চ, ২০১৫ তারিখে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার ওডিআইয়ে অংশ নেয়ার মাধ্যমে লিস্ট-এ খেলায় ইতি ঘটান।
নিজের সেরা সময়ে আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অবস্থানে ছিলেন। টেস্টের ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে পাঁচ নম্বর অবস্থানে থেকে ৩২৯ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। এছাড়াও, একমাত্র অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজ দেশে ও বিদেশে অভিষেক খেলায় শতক হাঁকিয়েছেন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০১৬ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গকালীন ধারাভাষ্যকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়েন। মার্ক নিকোলাস, শেন ওয়ার্ন, ইয়ান চ্যাপেল ও ইয়ান হিলি’র সাথে ধারাভাষ্য দেন।
রিকি পন্টিংয়ের সাথে যৌথভাবে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অ্যালান বর্ডার পদক লাভ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। কাইলি বোল্ডি নাম্নী এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেন। এ দম্পতির কেলসি লি নাম্নী এক কন্যা রয়েছে।
