৩ ডিসেম্বর, ১৯৭৬ তারিখে কেপ প্রভিন্সের ইস্ট লন্ডন এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও কোচ। মূলতঃ উইকেট-রক্ষক-ব্যাটসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এছাড়াও, ডানহাতে নিচেরসারির কার্যকর ব্যাটিংশৈলী প্রদর্শন করেছেন। পাশাপাশি, ডানহাতে মিডিয়াম বোলিং করতেন। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন।
৫ ফুট ৬ ইঞ্চি (১.৬৮ মিটার) উচ্চতার অধিকারী। ভার্ডন বাউচার ও হিদার বাউচার দম্পতির সন্তান। ১৯৯৫-৯৬ মৌসুম থেকে ২০১২ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে বর্ডার দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, আফ্রিকা একাদশ, আইসিসি বিশ্ব একাদশ, কেপ কোবরাজ, কলকাতা নাইট রাইডার্স, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ও ওয়ারিয়র্সের পক্ষে খেলেছেন।
১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়কালে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সর্বমোট ১৪৭ টেস্ট, ২৯৫টি ওডিআই ও ২৫টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে হ্যান্সি ক্রোনিয়ে’র নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের সদস্যরূপে পাকিস্তান গমন করেন। ২০ বছর বয়সে ১৭ অক্টোবর, ১৯৯৭ তারিখে শেখুপুরায় অনুষ্ঠিত স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। ৬ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তবে, বৃষ্টি ও বন্যার কারণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ফলাফলবিহীন অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
একই মৌসুমে ফিরতি সফরে নিজ দেশে রশীদ লতিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের মুখোমুখি হন। ৬ মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে জিকিবার্হায় অনুষ্ঠিত সফররত পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগতভাবে বেশ সফল ছিলেন। ৫২ ও ৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে আটটি ক্যাচ ও একটি স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়ান। খেলার চতুর্থ দিন নয়টি ডিসমিসাল ঘটিয়ে অপর দক্ষিণ আফ্রিকান ডিজে রিচার্ডসনের সাথে জাতীয় রেকর্ডের সমকক্ষ হন। তাঁর অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ২৫৯ রানে জয় পেলে সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। তিন-টেস্টের সিরিজে আঠারোটি ডিসমিসাল ঘটিয়ে নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়েন।
এরপর, একই মৌসুমে নিজ দেশে অর্জুনা রানাতুঙ্গা’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। ১৯ মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত সফররত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ঘটনাবহুল এ টেস্টের দ্বিতীয় দিন শন পোলকের সাথে ৯৫ রানের জুটি গড়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭ম উইকেটে নতুন রেকর্ড গড়েন। খেলায় তিনি ৩৩ ও ১০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, চতুর্থ দিন উইকেটের পিছনে অবস্থান করে ছয়টি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করে দক্ষিণ আফ্রিকান রেকর্ডের সমকক্ষ হন। উপর্যুপরী দ্বিতীয়বারের মতো এ সাফল্যের সন্ধান পান। খেলায় সাতটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। তবে, ২৬৪ রান সংগ্রহ করে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা দল তাদের সর্বনিম্ন রানের নজির গড়ে। শন পোলকের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৭০ রানে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে প্রথমবারের মতো ভারতের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে হান্সি ক্রোনিয়ে’র নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের সদস্যরূপে ভারত গমন করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০০ তারিখে মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়েতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্ট খেলেন। খেলায় তিনি ৩ ও ২৭* রান সংগ্রহসহ সাতটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসর হন। তবে, প্রতিপক্ষীয় অধিনায়ক শচীন তেন্ডুলকরের অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন সত্ত্বেও সফরকারীরা ৪ উইকেটে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
২০০০-০১ মৌসুমে নিজ দেশে সনথ জয়সুরিয়া’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। ২ জানুয়ারি, ২০০১ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত সফররত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। ঘটনাবহুল এ টেস্টের প্রথম দিন ডিসমিসাল ঘটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সেরাদের তালিকায় নিজেকে দ্বিতীয় স্থানে নিয়ে যান। খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ৯২ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, চারটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসর হন। শন পোলকের অসাধারণ বোলিং শৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ২২৯ রানে জয়লাভ করলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ বছর গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের সদস্যরূপে বাংলাদেশ সফরে যান। ২৪ এপ্রিল, ২০০৩ তারিখে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি উইকেটের পিছনে অবস্থান করে পাঁচটি ক্যাচ ও দুইটি স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়ান। অভিষেকধারী জ্যাক রুডল্ফের অসাধারণ ব্যাটিং দৃঢ়তায় খেলায় স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৬০ রানে পরাজিত হলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
টেস্ট অভিষেকের কয়েক বছরের মধ্যেই অজস্র রেকর্ড গড়ে ‘গিনেস’ উপনামে আখ্যায়িত হন। প্রায় প্রত্যেক মাইলফলকেই দ্রুততম ও কনিষ্ঠতম হিসেবে রেকর্ড গড়তে থাকেন। সংক্ষিপ্ত সময় অ্যাডাম গিলক্রিস্টের সাথে শীর্ষে অবস্থানের প্রশ্নে তুমুল লড়াইয়ের পর ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সালে সেরা উইকেট-রক্ষকে পরিণত হন। অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের সহায়তায় ২০০৮ সালে নিজের স্বর্ণালী মুহূর্ত উদযাপন করেন। ‘গিনেস’ থেকে ‘দ্য ফিনিশারে’ পরিণত হন। দৃঢ় প্রত্যয়ী মনোভাব ও স্থির মস্তিষ্কে নিয়মিতভাবে প্রচণ্ড চাপ সামলে অগ্রসর হতে থাকেন।
২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়সূচক রান তুলে ওডিআইয়ের সেরা খেলায় অসামান্য দৃঢ়তা দেখান। ৪৩৪ রানের তৎকালীন রেকর্ডকে দ্রুত ভেঙ্গে নিজেদের করে নেন। তবে, ধীরে ধীরে তাঁর খেলার মান নিচেরদিকে চলে যেতে থাকে। ২০১০ সালে নিজের শেষ ওডিআইয়ে অংশ নেন। এরপর, বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায়ও তাঁকে রাখা হয়নি। ২০১১ সালে আঘাতের কবলে পড়লে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবি ডি ভিলিয়ার্সের আগমন ঘটে ও তাঁকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়।
২০০৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে দারুণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। এজবাস্টন টেস্টে পাঁচ উইকেট পতনের পর ১১০ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় ধাবিত সফরকারীরা ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গন থেকে নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী সিরিজ বিজয় অর্জনে সমর্থ হয়। গ্রায়েম স্মিথের অপরাজিত ১৫৪ রানের সাথে তিনি ৪৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন।
২০০৯-১০ মৌসুমে নিজ দেশে অ্যান্ড্রু স্ট্রসের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ দলের মুখোমুখি হন। পুরো সিরিজে অসাধারণত্বের পরিচয় দেন। ১৪ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখে জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্টে সফররত ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ৬৬ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৫০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ৯৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে পাঁচটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসর হন। ডেল স্টেইন ও মরনে মরকেলের অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৭৪ রানে জয় পেলে সিরিজটি ১-১ ব্যবধানে অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। এ সিরিজে ৩৪১ রান সংগ্রহ করে গ্রায়েম সোয়ানের সাথে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার লাভ করেন।
২০১১-১২ মৌসুমে গ্রায়েম স্মিথের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের অন্যতম সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ২৩ মার্চ, ২০১২ তারিখে ওয়েলিংটনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ৩১ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৫৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। এ ইনিংসে তিনি ৪৬ রান সংগ্রহ করেন। তবে, দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁকে ব্যাটিং করতে হয়নি। এছাড়াও, চারটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলেও সফরকারীরা ১-০ ব্যবধানে সিরিজে জয়লাভ করে। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিশ্বস্ততার বিমূর্ত প্রতীক ছিলেন। খেলার সমাপ্তি ঘটাতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। অবিসংবাদিত বীর হিসেবে ল্যান্স ক্লুজনার ও জন্টি রোডসের সাথে একত্রে খেলে দলকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে যেতে অসামান্য অবদান রাখেন। অবশ্য, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে প্রবেশকালীন তাঁর খেলার কৌশল নিয়ে সমালোচনা, বিশ্লেষণ ও প্রায়শঃই নিষ্পিষ্টতার কবলে পড়েছিল। ২০০৯ সালে ইন্ডিয়ান টি২০ লীগে বেঙ্গালুরু দলের পক্ষে খেলেন। এরপর, পরের মৌসুমে কলকাতা নাইট রাইডার্সের পক্ষে খেলার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন। এক পর্যায়ে কোচিং জগতের দিকে ধাবিত হন। জুন, ২০২২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
২০০৮ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। কারমেন লটার নাম্নী এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেন।