লেন হাটন
২৩ জুন, ১৯১৬ তারিখে ইয়র্কশায়ারের ফালনেক এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ও পেশাদার ক্রিকেটার এবং প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ইংল্যান্ড দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। ধ্রুপদীশৈলীর ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৫ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে ইয়র্কশায়ারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৭ বছর বয়সে ইয়র্কশায়ারের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো অংশ নেন। চার বছরের মধ্যেই ইংল্যান্ড দলের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানে পরিণত হন।
১৯৩৭ থেকে ১৯৫৫ সময়কালে ইংল্যান্ডের পক্ষে সর্বমোট ৭৯ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। অংশগ্রহণকৃত টেস্টগুলো থেকে ১৯ শতক সহযোগে ৫৬.৬৭ গড়ে ৬৯৭১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৩৭ সালের গ্রীষ্মে নিজ দেশে কার্লি পেজের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ২৬ জুন, ১৯৩৭ তারিখে লন্ডনের লর্ডসে অনুষ্ঠিত সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। জিম পার্কসের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। জিম পার্কসের সাথে একত্রে ব্যাটিং উদ্বোধনে নামেন। ০ ও ১ রান তুললেও বর্ণাঢ্য খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রেখেছিলেন। অপরদিকে, জিম পার্কস ২৭ ও ৭ রান সংগ্রহ করলেও আর কোন টেস্টে খেলানো হয়নি। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
একই সফরের ২৪ জুলাই, ১৯৩৭ তারিখে ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে নিজেকে জড়ান। প্রথম ইনিংসে প্রথমবারের টেস্টে শতক হাঁকান। খেলায় তিনি ১০০ ও ১৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন। স্বাগতিকরা ১৩০ রানে জয় পেলে সিরিজে এগিয়ে যায়।
১৯৩৮ সালে বড় ধরনের অর্জনের সাথে যুক্ত হন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিনদিনের অধিক সময় নিয়ে ১৩ ঘণ্টা ১৭ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে ৩৬৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এ বিশ্বরেকর্ডটি দুই দশকের অধিক সময় টিকেছিল।
প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ফিল্ডিংয়ে বাঁধা দেয়ার কারণে বিদায়ের ঘটনায় নিজেকে জড়ান। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট চলাকালে রাসেল এনডিনের সাথে এ ঘটনা ঘটে।
আঘাতের কারণে বামহাত দুই ইঞ্চি টান পড়লেও সঠিকমানের কৌশল অবলম্বন করে নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। মার্চ, ১৯৪১ সালে ইয়র্ক ব্যায়ামাগারে শারীরিক প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্নের শেষদিনে মেঝেতে গুরুতর আঘাত পান। এরফলে, এক্স-রেতে তাঁর বাহুতে চিড় ধরা পড়ে।
এক সময় তিনি খেলার জগতে ফিরে আসেন। প্লাম ওয়ার্নার একাদশের সদস্যরূপে আরএএফের বিপক্ষে খেলেন। নিম্নমূখী রানের খেলায় ১৯ রান তুলে দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। ঐ খেলা শেষে পুণরায় আঘাতের কবলে পড়েন। ১৯৪২ সালের গ্রীষ্মে আঘাত ধীরলয়ে শেষ হলেও বামহাত দুই ইঞ্চি খাঁটো হয়ে যায়। পরিমার্জিত কৌশল অবলম্বনে তাঁকে আর হুক মারতে দেখা যায়নি।
১৩ টেস্ট থেকে ৬৭.২৫ গড়ে ৩৬৪ রানের বিশ্বরেকর্ড সাথে নিয়ে ১৩৪৫ রান তুললেও তাঁর ভবিষ্যতের বিষয়ে বিরাট প্রশ্ন এনে দেয়। ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪২ সালে রিচার্ড হাটন নামীয় সন্তান জন্মগ্রহণ করে ও পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের পক্ষে পাঁচ টেস্টে অংশ নেয়। ঐ সময়ে সুস্থ হতে থাকেন ও আত্মবিশ্বাসের সাথে নবজাতককে কোলে তুলে নেন। ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসের শেষদিকে খেলায় ফিরে আসেন। পাডসে সেন্ট লরেন্সের সদস্যরূপে ব্যাংকফুটের বিপক্ষে ঐ খেলায় শূন্য রানে বিদেয় নেন। এরফলে, সেকেন্ড গ্রেড, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট ও টেস্ট ক্রিকেট – প্রত্যেক স্তরের ক্রিকেটের অভিষেকে শূন্য রানের সন্ধান পান। অল্প কিছুদিন পর সার্জন রেজিনাল্ড ব্রুমহেড ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের আজীবন সদস্যরূপে মনোনীত হলে আবারও তাঁর খেলার পথ সুগম হয়।
বিশ্বযুদ্ধের পর বালকদের হালকা ওজনের ব্যাট ব্যবহার করতে বাধ্য হন। তাসত্ত্বেও অবিস্মরণীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে চিত্রিত হন। তাসত্ত্বেও, জুন, ১৯৪৯ সালে এক মাসেই সাত শতক সহযোগে রেকর্ডসংখ্যক ১২৯৪ রান তুলেন। ঐ বছর নিজ দেশে ওয়াল্টার হ্যাডলি’র নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ১৩ আগস্ট, ১৯৪৯ তারিখে লন্ডনের ওভালে সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। দলের একমাত্র ইনিংসে ২০৬ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলে অমিমাংসিত অবস্থায় সিরিজটি শেষ হয়।
১৯৫০-৫১ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে ফ্রেডি ব্রাউনের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ১৭ মার্চ, ১৯৫১ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। একবার ব্যাট হাতে নিয়ে ২৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৫১ সালে নিজ দেশে ডাডলি নোর্সের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের মুখোমুখি হন। ১৬ আগস্ট, ১৯৫১ তারিখে লন্ডনের ওভালে অনুষ্ঠিত সফররত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ঘটনাবহুল এ টেস্টে মাঠে বল অবৈধভাবে প্রতিহত করার কারণে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে অপ্রত্যাশিতভাবে বিদেয় নেন। স্ট্যাম্পে বল আঘাতের বিষয়টি দ্বিতীয়বারের মতো করেন। কিন্তু, এ পর্যায়ে উইকেট-রক্ষক ডব্লিউআর এনডিন ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসরকালীন তিনি বাঁধা দিয়েছিলেন। খেলায় তিনি ২৮ ও ২৭ রান সংগ্রহসহ তিনটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। সফরকারীরা ৪ উইকেটে পরাজিত হলে ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়।
সর্বকালের অন্যতম সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ও ইংল্যান্ডের অন্যতম সফলতম অধিনায়ক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে এসে ১৯৫২ সালে ইংল্যান্ডের প্রথম পেশাদার অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন। ভারত দলকে ৩-০ ব্যবধানে পরাজিত করে তাঁর দল ও ব্যাটিং গড়ে শীর্ষে ছিলেন।
১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ২৫ মার্চ, ১৯৫৫ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত টেস্ট খেলেন। খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ৫৩ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। ইনিংস ও ২০ রানে জয়লাভ করলে সফরকারীরা ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যস্ত থাকলেও ইয়র্কশায়ারের প্রতি দায়িত্ব পালন করা থেকে দূরে সড়ে ছিলেন না। দলের অধিনায়ক ছিলেন না। ১৯৫০ সালে আর্থিক সুবিধা গ্রহণের খেলার জন্যে মনোনীত হন। কর বহির্ভূত অবস্থায় £৯,৭১৩ পাউন্ড-স্টার্লিং লাভ করেন। অর্থের দিক দিয়ে এটি যে-কোন ইয়র্কশায়ারীয় খেলোয়াড়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।
১৯৫৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের পর নাইটহুড পদবী ধারন করেন। জুন, ১৯৫৫ সালে নটিংহ্যামশায়ারের বিপক্ষে ১৯৪ রান তুলেন। নিজস্ব ১২৯তম ও সর্বশেষ প্রথম-শ্রেণীর শতক হাঁকান। তবে, পরবর্তী জানুয়ারি মাসে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে ইয়র্কশায়ার থেকে বিদেয় নেন। ধারাভাষ্যে হ্যারি অ্যাল্থাম মন্তব্য করেন যে, ক্রিকেটের ইতিহাসের এক সেরা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সব মিলিয়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ১২৯ শতক সহযোগে ৫৫.৫১ গড়ে ৪০৪১০ রানের সন্ধান পেয়েছেন। এর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ ইয়র্কশায়ারের পক্ষে করেছেন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর প্রশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সময়কালে টেস্ট দল নির্বাচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ধারাভাষ্যকারসহ সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হন ও আর্থিক তহবিল বৃদ্ধির সাথে জড়িত হন। এছাড়াও, ফেনার ইন্টারন্যাশনাল (পাওয়ার ট্রান্সমিশন) লিমিটেডের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ব্যবসা থেকে অবসর নেন। তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে, ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ‘ফিফটি ইয়ার্স ইন ক্রিকেট’ সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। আরএ হাটন ও জেএল হাটন নামীয় সন্তানের জনক ছিলেন। ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ তারিখে সারের কিংস্টন হাসপাতালে ৭৪ বছর ৭৫ দিন বয়সে তাঁর দেহাবসান ঘটে। মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে লর্ডসে ন্যাটওয়েস্টের চূড়ান্ত খেলা দেখেছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর শবানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও পুটনি ভ্যাল সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ইয়র্ক মিনস্টারে লিভারপুলের বিশপ ও সাবেক দলীয় সঙ্গী ডেভিড শেফার্ডের সভাপতিত্বে শোকসভার অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ অক্টোবর, ১৯৯০ তারিখে তাঁর সম্পদের পরিমাণ £৩৮৫,৪৬৫ পাউন্ড-স্টার্লিং ধার্য্য করা হয়।