জ্যাক হবস
১৬ ডিসেম্বর, ১৮৮২ তারিখে কেমব্রিজে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার। ইংরেজ ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম শীর্ষসারির ব্যাটসম্যান ছিলেন। প্রথম পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ১৯৫৩ সালে নাইট উপাধীতে ভূষিত হয়েছিলেন। প্রায় ত্রিশ বছর পেশাদারী পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছেন। হার্বার্ট সাটক্লিফ ও লেন হাটনের সাথে তাঁকেও বৈশ্বিকভাবে সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের মর্যাদা দেয়া হয়। ‘দ্য মাস্টার’ নামে পরিচিত ছিলেন। দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনে ক্রমাগত রান তুলেছেন।
১৮৮৯ সালে জিসাস কলেজের মাঠ কর্মকর্তা ও পেশাদার আম্পায়ার জন হবস দম্পতির ছয় পুত্র ও ছয় কন্যার মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ ছিলেন। ক্রিকেটপ্রেমী জন হবস তাঁর সন্তানকে ১৮৮৪ সালে ফেনার্সের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখাতে নিয়ে যান। এ সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ মাস। তবে, প্রচলিত রয়েছে যে, তাঁর চিৎকার বাউন্ডারি সীমানায় অবস্থানকারী জনৈক অস্ট্রেলীয় ফিল্ডারের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। বিদ্যালয়ের ছুটির দিনগুলোয় ঐ মাঠে অনুশীলন করার সুযোগ পেতেন ও কলেজের ভৃত্যদের সাথে টেনিস বল নিয়ে নিজস্ব ঘরানার ক্রিকেট খেলতেন।
১৯৯টি শতরানের ইনিংস খেলে অদ্যাবধি প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বাধিক শতক হাঁকানোর রেকর্ডের অধিকারী। এছাড়াও, ৪৬ বছর বয়সে ১৯২৮-২৯ মৌসুমে বয়োজ্যেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে টেস্ট শতক হাঁকিয়েছেন। চল্লিশের বয়সে থেকে সর্বাধিকসংখ্যক রান সংগ্রহের কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর। অর্ধেক শতরানই চল্লিশের পর করেছেন। চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণের পর বিস্ময়করভাবে ৫৮.০৯ গড়ে ২৪৪০ রান তুলেন। এ বয়সে এসে কেবলমাত্র প্যাটসি হেনড্রেন (১৯০১), টম গ্রেভনি (১২৪৩) ও মিসবাহ-উল-হক (১১৩৪) রান তুলে তাঁর পিছনে অবস্থান করছেন। চল্লিশের বয়সে এসে সর্বাধিকসংখ্যক আটটি শতক হাঁকান। তাঁর পিছনে রয়েছেন – মিসবাহ-উল-হক (৪)।
৮৩৪টি খেলা থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব গড়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৬১৭৬০ রান সংগ্রহ করেছেন। ৫২ বছর বয়সেও প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নিয়ে বেশকিছু ব্যাটিং রেকর্ডের স্থানে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
আত্মনির্ভরশীল ছিলেন ও কখনো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। পিতার সহযোগিতায় ক্রিকেটের প্রতি আসক্তি গড়ে উঠে। শৈশবের অধিকাংশ সময়ই এ খেলায় ব্যয় করেন। পেশাদারী পর্যায়ে ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি লাভের পূর্বে কলেজে ভৃত্য হিসেবে কাজ করতেন। চরম দারিদ্র্যতার মধ্যে বড় হন। কিন্তু, সর্বদাই পেশাদারী পর্যায়ে ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন। ১২ বছর বয়সে কেমব্রিজের সেন্ট ম্যাথিউজের চার্চ চয়ের একাদশে প্রথম খেলেন। আইভি বয়েজ ক্লাব গঠনে সহায়তা করেন। রঞ্জিতসিংজী সেখানেই অনুশীলন করতেন। হব্স তাঁর কব্জীর মোচরে দর্শনীয় ব্যাটিংশৈলী পর্যবেক্ষণ করতেন। কিন্তু ড্যান হেওয়ার্ডের সন্তান টম হেওয়ার্ডকেই শৈশবে বীর হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন। ১৯০১ সালে স্থানীয় দলে খেলেন। কেমব্রিজশায়ারের পক্ষে কিছু সময় শৌখিন খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নেন।
১৯০২ সালে প্রথমবারের মতো পেশাদারী পর্যায়ে যুক্ত হন। বেডফোর্ড গ্রামার স্কুলের দ্বিতীয় কোচ ও দ্বিতীয় আম্পায়ার হন। ঐ বছরের আগস্ট মাসে রয়স্টোনের কাছ থেকে সহায়তা পান। প্রতি খেলায় অংশগ্রহণে অর্ধ-গিনি লাভ করেন। হার্টস ক্লাব এন্ড গ্রাউন্ডের বিপক্ষে চমৎকার শতক হাঁকান। পিতা তাঁর সাফল্যে বেশ চমৎকৃত হন। কিন্তু সন্তানের আরও উত্তরণ দেখার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। পরিবারকে সহায়তাকল্পে টম হেওয়ার্ড দাতব্য তহবিল গঠনের খেলা আয়োজন করেন। পরিবারের অপর বন্ধু মি. এফসি হাট তাঁকে জ্যাকের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। পার্কার্স পিসে এসেক্সের বোলার উইলিয়াম রিভসের বিপক্ষে ২০ মিনিটের ব্যাটিং কৌশল দেখানোর আয়োজন করেন ও তাতে বেশ মুগ্ধ হন। এরফলে, পরবর্তী বসন্তকালে ওভালে তাঁর যাচাইবাছাইয়ের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু, এসেক্স কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিরাশ করে। ফলশ্রুতিতে, এপ্রিল, ১৯০৩ সালে সারেতে চলে যান ও তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়ে দলে নেয়। দুই বছর শিক্ষানবীশকালীন সময়ে উত্থান-পতনের মাধ্যমে সময় অতিবাহিত করেন। ব্যাটারসীর বিপক্ষে ওভালে সারে কোল্টসের পক্ষে প্রথম খেলায় শূন্য রানের সন্ধান পান। তবে, খুব শীঘ্রই নিজের প্রতিশ্রুতিশীলতা তুলে ধরেন।
সারে ক্লাব এন্ড গ্রান্ডের প্রথম খেলায় গাইজ হসপিটালের বিপক্ষে ৮৬ রান তুলেন। ১৯০৪ সালে শিক্ষানবীশকালীন দ্বিতীয় বছরে কেমব্রিজশায়ারের পক্ষে বেশ কয়েকটি খেলায় পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নেন। হার্টফোর্ডশায়ারের বিপক্ষে দূর্দান্ত ১৯৫ রান তুলেন। ১৯০৫ সালে শিক্ষানবীশকাল শেষ হলে সারের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্যময় খেলোয়াড়ী জীবনের যাত্রা শুরু করেন। বিশ্বব্যাপী সুনাম কুড়ান ও প্রথম পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে রাণীর কাছ থেকে নাইটহুড লাভ করেন।
লর্ড ডালমেনি’র কাছ থেকে কাউন্টি ক্যাপ লাভ করেন। এসেক্সের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নশীপের প্রথম খেলায় ১৫৫ রান তোলার পর মাস্টার ক্রিকেটারের সম্মাননা পান। দি ওভালে হবস গেটস ও পার্কার্স পিসে জ্যাক হবস প্যাভিলিয়ন নামীয় স্মারকসূচক স্থায়ী মর্যাদার আসনে তাঁকে রাখা হয়। সন্দেহাতীতভাবে ডব্লিউজি গ্রেসের পর সর্বাপেক্ষা সেরা ব্যাটসম্যানের মর্যাদা পান। ৫০.৬৫ গড়ে ১৯৭ শতক সহযোগে ৬১২৩৭ রান তুলেন। ৬১ টেস্ট খেলায় অংশ নেন।
২৪ এপ্রিল, ১৯০৫ তারিখে ইস্টার মানডেতে ২২ বছর চার মাস বয়সে সারে দলের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। ডব্লিউজি’র অধিনায়কত্বে প্রতিপক্ষীয় ইংল্যান্ড জেন্টলম্যানের বিপক্ষে ১৮ ও ৮৮ রান তুলেন। তন্মধ্যে শেষ ইনিংসে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিলেন। গ্রেস কল্পনাতেও আনেননি যে, ২০ বছর পর তিনি ১২৬ শতকের রেকর্ড ভেঙ্গে নিজের করে নেবেন। এ ইনিংস খেলার পর পরের খেলাতেই শতক হাঁকান। পরের কয়েক মৌসুম চমৎকার ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনের পর জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্যে আমন্ত্রণ বার্তা লাভ করেন। এ পর্যায়ে সারের টম হেওয়ার্ড ও অ্যান্ডি স্যান্ডহাম এবং ইংল্যান্ডের উইলফ্রেড রোডস ও হার্বার্ট সাটক্লিফের সাথে কার্যকর উদ্বোধনী জুটি গড়েছিলেন।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার দুই মৌসুম পর ১৯০৭ সালে বার্ট ভোগলার, গর্ডন হোয়াইট, অব্রে ফকনার ও সোয়ার্জের ন্যায় গুগলি বোলার নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা দল ইংল্যান্ড সফলে আসলে কেবলমাত্র দুইবার খেলার সুযোগ পান। সারের পক্ষে ১৮ ও ৪১ এবং স্কারবোরায় সিআই থর্নটন একাদশের পক্ষে ৭৮ ও ৫ রান তুলতে সক্ষম হন। জেটি টিল্ডসলে, ব্রন্ড, জেসপ ও স্পুনারের পাশাপাশি জর্জ গানের দলের বিপক্ষে নিজের শক্তিমত্তার পরিচয় দেয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯০৭-০৮ মৌসুমে এ. ও. জোন্সের নেতৃত্বে এমসিসি দলের সদস্যরূপে প্রথমবারের মতো বিদেশ সফর হিসেবে অস্ট্রেলিয়া যান।
১৯০৮ থেকে ১৯৩০ সময়কালে ইংল্যান্ডের পক্ষে সর্বমোট ৬১ টেস্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১ জানুয়ারি, ১৯০৮ তারিখে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। জো হামফ্রিজের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় তিনি ৮৩ ও ২৮ রান সংগ্রহ করে অভিষেক পর্বকে স্মরণীয় করে রাখেন। নাটকীয়ভাবে ১ উইকেটে জয় পেলে সফরকারীরা পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে সমতা আনতে সক্ষম হয়।
দুই বছর পর এমসিসি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যায় ও সেখানে তিনি স্পিনারদের বিপক্ষে ম্যাটিং উইকেটে দারুণ সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯০৯-১০ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা দল ৩-২ ব্যবধানে রাবার জয় করে। ঐ সিরিজে ৬৭.৩৭ গড়ে ৫৩৯ রান তুলে পরবর্তী সেরা ব্যাটসম্যান থম্পসনের সংগৃহীত ৩৩.৭৭ গড়ের চেয়ে দ্বিগুণ এগিয়ে রাখেন।
১৯০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁকে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামানো হয়। প্রথম ইনিংসে ৮৩ রানের দারুণ ইনিংস খেলার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮ রান তুলেন। এরফলে, এমসিজিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর দল জয় পায়। পরবর্তীতে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় পাল্টা আক্রমণে ৫৭ রান তুলেন। কিন্তু, পরের কয়েকটি খেলায় তেমন সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি।
নিজস্ব প্রথম টেস্ট শতক লাভের জন্যে দুই বছর প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে হয়। কেপটাউনে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৮৭ রান তুলে দলে স্থান পাকাপোক্ত করে তুলেন। ১৯০৯-১০ মৌসুমে হেনরি লেভসন গাওয়ারের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ১ জানুয়ারি, ১৯১০ তারিখে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। বেশ কয়েকবার ব্যক্তিগতভাবে সফল ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ৮৩ রান অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে ৬৬ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ৮৯ ও ৩৫ রান সংগ্রহ করে উভয় ইনিংসে বার্ট ভোগলারের শিকারে পরিণত হন। এছাড়াও, ০/২০ ও ০/১৬ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। সফরকারীরা ১৯ রানে পরাভূত হলে পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
এরপর, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯১০ তারিখে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার ছাঁপ রাখেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ৮৯ রান অতিক্রম করেন। খেলায় তিনি ১১ ও ৯৩* রান সংগ্রহ করেছিলেন। সফরকারীরা ৩ উইকেটে জয় পেলেও পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২-১ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকে।
একই সফরের ১১ মার্চ, ১৯১০ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগতভাবে বেশ সফল ছিলেন। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ৯৩ রান অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে টেস্টে নিজস্ব প্রথম শতক হাঁকান। একবার ব্যাট হাতে নিয়ে ১৮৭ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ০/১১ ও ১/১৯ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। ৯ উইকেটে জয়লাভ করলেও সফরকারীরা ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়।
১৯১১-১২ মৌসুমের অ্যাশেজ সিরিজে উপর্যুপরী তিনটি শতক হাঁকান। এ পর্যায়ে এমসিজিতে অনুষ্ঠিত টেস্টে হার্বার্ট সাটক্লিফকে নিয়ে ৩২৩ রানের জুটি গড়েন। প্রথম জুটি হিসেবে যে-কোন উইকেটে তাঁরা ২৫০ ও ৩০০ রান তুলেছেন। কেবলমাত্র সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি; বরঞ্চ বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবেও সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। এ সফলতার পিছনে শীর্ষসারিতে ভীতিহীন অবস্থায় আক্রমণাত্মক ধাঁচের ব্যাটিং জড়িত ছিল।
উইলফ্রেড রোডস ও হার্বার্ট সাটক্লিফের সাথে ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমে বিস্ময়কর সফলতা পেয়েছেন। তন্মধ্যে, টেস্ট ক্রিকেটে গড়ের দিক থেকে সর্বাপেক্ষা কার্যকর উদ্বোধনী জুটিরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। এছাড়াও, উদ্বোধনী জুটিতে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী অপর দুই ইংরেজ ব্যাটসম্যান জ্যাক হবস ও উইলফ্রেড রোডস ৬১.৩১ রান করেছেন। কমপক্ষে ২০০০ রান সংগ্রহকারী যে-কোন উদ্বোধনী জুটিতে তাঁরা শীর্ষে রয়েছেন।
ইয়র্কশায়ারীয় ব্যাটসম্যান হার্বার্ট সাটক্লিফকে সাথে নিয়ে উদ্বোধনী জুটিতে স্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষকই বিভিন্ন কারণে তাঁদের মধ্যকার জুটিকে বিশ্বের সেরা জুটিরূপে আখ্যায়িত করেছেন। ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫ সালে মেলবোর্নে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তাঁরা ২৮৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এটি তাঁদের উপর্যুপরী তৃতীয় শতরানের জুটি ছিল। ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ৬ বছরে তাঁরা ইংল্যান্ডের পক্ষে ৩২৪৯ রান তুলেছিলেন। এ সংখ্যাটি সর্বকালের তালিকায় ৮ম স্থানে অবস্থান করছে। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে কমপক্ষে ১০০০ রান সংগ্রহকারী যে-কোন উদ্বোধনী জুটির তুলনায় তাঁরা ৮৭.৮১ গড়ে রান পেয়ে ২০১৪/অদ্যাবধি শীর্ষে অবস্থান করছেন।
৩৮বার জুটি গড়ে তাঁরা ৩২৪৯ রান পেয়ে খুব সহজেই যে-কোন জুটির তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যকার ১৫বার শতরানের জুটি কেবলমাত্র গর্ডন গ্রীনিজ ও ডেসমন্ড হেইন্স ৪৭.৩১ গড়ে ১৬টি শতক করে নিজেদের অনুকূলে রেখেছেন। প্রায় ছয় দশক পর তাঁরা দুইবার আড়াইশত রান তুলে দ্বিতীয় জুটি হিসেবে হবস-সাটক্লিফের সাথে রয়েছেন।
১৯১২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০৭ রানের দারুণ ইনিংস খেলে প্রথমবারের মতো লর্ডস অনার্স বোর্ডে নিজের নাম লেখান। ইংরেজ অধিনায়ক সি.বি. ফ্রাই টসে জয়লাভ করে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলে শীর্ষসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের সেরা খেলা প্রদর্শনের সুযোগ পান। প্রথম দিনে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা এবং দ্বিতীয় দিনে মাত্র ২০ মিনিট খেলা হলে অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে ড্রয়ে পরিণত হয়। তবে, এ সময়টুকুই তাঁর জন্যে যথেষ্ট ছিল। ১৬৭ মিনিট খরচ করে ১৫টি চারের সাহায্যে ক্রিকেটের স্বর্গভূমি লর্ডসে ১০৭ রান তুলেন।
দুই ভাগে বিভক্ত ছিল তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন। ১৯১৯ সালে ক্রিকেট খেলা শুরুকালীন রয়্যাল ফ্লাইং কোরে এয়ার মেকানিক হিসেবে স্বল্পকালীন কাজ করেন। ১৯২১ সালে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কারণে তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন হুমকির মুখোমুখি হয়। তবে, কিছুদিন পরই খেলার জগতে ফিরে আসেন। এ পর্যায়ে খেলার ধরন পাল্টে ফেলেন ও সতর্ক ভঙ্গীমায় ব্যাটিং করতেন।
১৯২৪ সালে নিজ দেশে হার্বি টেলরের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের মুখোমুখি হন। ১৪ জুন, ১৯২৪ তারিখে বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত সফররত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ৩০ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৩০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি একবার ব্যাটিংয়ে নেমে ৭৬ রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। ইনিংস ও ১৮ রানে পরাজিত হলে সফরকারীরা পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
এরপর, ২৮ জুন, ১৯২৪ তারিখে লর্ডসে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে দারুণ খেলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ১২ বছর পর ক্রিকেটের স্বর্গভূমিতে প্রথম খেলেন। প্রতিপক্ষকে ২৭৩ রানে গুটিয়ে দেয়ার পর উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে এ মাঠে উপর্যুপরী দ্বিতীয় শতকের সন্ধান পান। ব্যক্তিগত সফলতার সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ১৮৭ রান অতিক্রম করেন। খেলায় তিনি ব্যাট হাতে নিয়ে দলের একমাত্র ইনিংসে ১৫টি চারের সাহায্যে ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিয়ে ২১১ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তন্মধ্যে, উদ্বোধনী জুটিতে হার্বার্ট সাটক্লিফের (১২২) সাথে ২৬৮ ও দ্বিতীয় উইকেটে ফ্রাঙ্ক ওলি’র (১৩৪) সাথে ১৫২ রানের জুটি গড়েছিলেন। এরফলে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ৫৩১/২ তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। দ্বিতীয় ইনিংসে সফরকারীদেরকে ২৪০ রানে গুটিয়ে দিয়ে ইংল্যান্ড দল ইনিংস ও ১৮ রানে জয় পেলে পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
১৯২৪-২৫ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে যাননি। তিনি মন্তব্য করেন যে, যদি স্বীয় স্ত্রী অ্যাডাকে এমসিসি কর্তৃপক্ষ তাঁর সাথে যাবার অনুমতি দিতো তাহলে তিনি যেতেন।
১৯২৬ সালে লর্ডসে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১১৯ রানের মনোরম ইনিংস উপহার দেন। এরফলে, এ মাঠে উপর্যুপরী তিনবার শতরান করার গৌরব অর্জন করেন। ১৪টি চারের মারে ২৪৭ মিনিটে তিনি এ রান তুলেন। এটিই লর্ডসে তাঁর সর্বশেষ শতক ছিল। সর্বোপরী স্বাগতিক ইংল্যান্ড দলকে সম্ভাব্য পরাজয় থেকে এড়িয়ে নিয়ে তিনদিন পর ড্রয়ে পরিণত করে।
১৯২৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সর্বশেষ শতক হাঁকানোর পূর্বে ১১ টেস্টে ৭টি শতরানের ইনিংস খেলেন। ৪০ বছর বয়সে শততম শতকের সন্ধান পান। ৪৮ বছর বয়সে সর্বশেষ টেস্ট সিরিজ খেলেন। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে অস্ট্রেলীয় ফাস্ট বোলার টিম ওয়ালের সাথে ধাক্কায় পড়ে যান। ঘিরে রাখা অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের পাশ কাটিয়ে খেলা দেখতে আসা দর্শকদের একজন চিকিৎসক পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁকে দেখে তিনি বললেন, ‘আপনার কাছে কি একটি সিগার হবে?’
১৯৩০ সালে নিজ দেশে বিল উডফুলের নেতৃত্বাধীন অজি দলের মুখোমুখি হন। ১৬ আগস্ট, ১৯৩০ তারিখে লন্ডনের ওভালে অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ৪৭ ও ৯ রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। সফরকারীরা ইনিংস ও ৩৯ রানে জয় পেলে সফরকারীরা ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়। এ টেস্ট শেষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। ৬১ টেস্ট থেকে ১৫টি শতক হাঁকান।
প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিদেশের একটি মাঠে সহস্র রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। এমসিজিতে ৬৯.২৯ গড়ে ১১৭৮ রান তুলেছেন। নিরপেক্ষ মাঠ হিসেবে দুবাইয়ে ইউনুস খান ১০২৪ ও হেডিংলিতে ডন ব্র্যাডম্যান ৯৬৩ রান তুলেছেন।
অবসর গ্রহণকালীন টেস্টে ৫৬.৯৪ গড়ে ৫৪১০ রান তুলেন। পরবর্তী স্থানে থাকা ক্লেম হিলের চেয়ে প্রায় দুই হাজার রানের ব্যবধানে এগিয়েছিলেন। তবে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে চলে আসলেও আরও কয়েক বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে সরব ছিলেন।
৩০ বছরের অধিক সময় সারে ক্লাবে অতিবাহিত করেন। ওভাল তাঁর প্রিয় মাঠ ছিল কেননা সর্বদাই সেখানে বিরাট ভোজন করা হতো। তাঁর সম্মানার্থে ওভালের প্রবেশ পথের নামকরণ করা হয়। ১৯৫২ সালে শুরুতে প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীতে নাইটহুড পদবী ধারণ করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, এ সম্মানটুকু শুধুমাত্র তাঁকে করা উচিৎ হয়নি; বরঞ্চ সকল পেশাদার ক্রিকেটারকে দেয়া উচিৎ। ১৯৬৩ সালে ৮১ বছর বয়সে অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর দেহাবসান ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অধিকাংশ পেশাদার ক্রিকেটার সেনাবাহিনীতে যোগদান করলেও তিনি সামরিক কারখানায় কাজ করার পাশাপাশি ওয়েস্টমিনস্টারের খ্যাতনামা পাবলিক স্কুলের ক্রিকেট কোচের দায়িত্ব পালন করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু সময় পিটি ইন্সট্রাক্টর ছিলেন। ১৯১৫ সালে ব্রাডফোর্ড লীগে পেশাদারী পর্যায়ে চুক্তিবদ্ধ হন। ওয়াইপ্রেসের দ্বিতীয় যুদ্ধ ও লুসিতানিয়ায় জার্মান ইউ-বোটে সহস্রাধিক ব্যক্তি নিহত হবার পর তাঁর এ চুক্তিবদ্ধতাকে লর্ড হক কলঙ্কময় হিসেবে গণ্য করেন। এরপর তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিনিধির কাছে এক পত্রে তিনি লেখেন যে, তিনি কিছুটা বোকাটে এবং তিনি এ কথা লিখতেই পারেন না।
হ্যারল্ড লারউড তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ১৯১৯ সালে উজ্জ্বল চোখের অধিকারী লারউডের বয়স ১৪ ছিল ও ১২ মাইল হেঁটে ট্রেন্ট ব্রিজে তাঁর ব্যাটিংশৈলী দেখতে আসেন। স্বীয় আসনে বসার প্রথম বলেই হবস বিদেয় নেন। হার্বার্ট সাটক্লিফের সুপারিশক্রমে ভিজ্জি তাঁকে তাঁর দলে খেলার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। রবিবারে অনুষ্ঠিত কলকাতা স্পোর্টিং ইউনিয়নের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত একটি খেলায় ধর্মীয় কারণে অংশগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন।
১৯৩০-৩১ মৌসুমে হার্বার্ট সাটক্লিফের সাথে একত্রে বিজিয়ানাগ্রামের মহারাজকুমারের ব্যক্তিগত দলে যোগ দেন এবং ভারত ও সিলন গমন করেন। ঐ সফরে দুইটি শতকসহ ৫৯৩ রান তুলেছিলেন তিনি। তবে, আঘাতের কারণে খুব দ্রুত ঘরোয়া পর্যায়ের ক্রিকেটে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। তবে, সারে কর্তৃপক্ষ তাঁকে যখন খুশী তখন খেলার অনুমতি প্রদান করে। ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৫ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে বিদেয় নেন।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসরগ্রহণকালীন ৫০.৭০ গড়ে ৬১৭৬০ রান তুলেন। আট দশকের অধিক সময় ধরে তাঁর এ রেকর্ড টিকে আছে। উইজডেনের তথ্য মোতাবেক তিনি ১৯৭টি শতরানের ইনিংস খেলেন। তবে, অধিকাংশ ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদ ১৯৩০-৩১ মৌসুমে ভিজ্জি’র দলের সাথে যুক্ত থেকে আরও দুইটি শতরানকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ঐ দলটিতে হার্বার্ট সাটক্লিফও খেলেছেন ও পরবর্তীকালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের মর্যাদা দেয়া হয়। এগুলো বাদ দিলেও প্যাটসি হেনড্রেনের সংগৃহীত ১৭০ শতকের তুলনায় নিজেকে শীর্ষে নিয়ে যান। এরফলে, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বাধিকসংখ্যক শতক হাঁকানোর কৃতিত্বের অধিকারী হন। এছাড়াও, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বাধিকসংখ্যক ২৭৩টি অর্ধ-শতরানের ইনিংস খেলেন।
১৯০৯ ও ১৯২৬ সালে উইজডেন কর্তৃক বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননায় ভূষিত হন। পেলহাম ওয়ার্নারের সাথে কেবলমাত্র তিনিই দুইবার এ সম্মাননা লাভ করেন। এছাড়াও, ২০০০ সালে উইজডেন কর্তৃক শতাব্দীর সেরা ক্রিকেটার হন। ১৯৫৩ সালে প্রথম পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে নাইটহুড পদবী লাভ করেন। ২০০৯ সালে ক্রিকেট ইতিহাসবিদ ও লেখক কর্তৃক ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা একাদশের সদস্যসহ ক্রিকেটের ইতিহাসে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত দলে স্থান পান।
সূক্ষ্ম পায়ের কারুকাজসহ বৈচিত্র্যমূখী শটে পটু ছিলেন ও বলকে নির্দিষ্ট স্থানে প্রেরণে সক্ষমতা দেখান। নিজস্ব কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি নতুন ধাঁচের বোলিংয়ের মুখোমুখি হয়েছেন। কার্যকর রক্ষণাত্মক পন্থা অবলম্বনসহ ধ্রুপদী শট খেলতেন।