ইমরান খান
৫ অক্টোবর, ১৯৫২ তারিখে পাঞ্জাবের লাহোরে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার, প্রশাসক, তেহরিক-ই-ইনসাফের প্রধান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। মূখ্যতঃ অল-রাউন্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। ডানহাতে ফাস্ট বোলিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে কার্যকর ব্যাটিংশৈলী প্রদর্শনে পারদর্শী ছিলেন। পাকিস্তান দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্ণাঢ্যময় চরিত্রের অধিকারী। পাকিস্তানী ক্রিকেটে প্রধান পটপরিবর্তনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের ক্রিকেটকে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হৃদপিণ্ডতুল্য ভূমিকা রাখেন। খুব কমসংখ্যক ক্রিকেট বিশ্লেষকই পাকিস্তানের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে দ্বি-মত পোষণ করবেন। জনপ্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পাশাপাশি সর্বাপেক্ষা সফলতম অধিনায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে দৃষ্টিনন্দন ভূমিকা রাখতেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর দশকে উপমহাদেশের ক্রিকেটে প্রকৃত ‘সুদর্শন পুরুষের’ পরিবেশ সৃষ্টি করেন।
উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা ইকরামুল্লাহ খান নিয়াজী পুরপ্রকৌশলী ও জমিদার এবং মাতা শওকত খানম গৃহিনী ছিলেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিমাংশের মিনওয়ালিতে অপর চার বোন জন্মগ্রহণ করে। মাতৃসম্পর্কীয় বার্কি পাঠান ও পিতৃ সম্পর্কীয় পশতুন জাতিগোষ্ঠীর নিয়াজি বংশোদ্ভূত পরিবারের সন্তান। পাকিস্তানের বিশ্ব অঙ্গনে প্রবেশের পূর্বে ভারতের পক্ষে টেস্টে অংশ নেয়া বাকা জিলানী ও জাহাঙ্গীর খান তাঁর মাতৃ সম্পর্কীয় চাচা ছিলেন। দুই চাচাতো ভাই ও জাহাঙ্গীর খানের পুত্রদ্বয় – জাভেদ বার্কি ও মজিদ খান পাকিস্তানের পক্ষে বর্ণাঢ্যময় টেস্ট খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন ও জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৬ ফুট ১ ইঞ্চি (১.৮৫ মিটার) উচ্চতার অধিকারী। ১৯৬৯-৭০ মৌসুম থেকে ১৯৯১-৯২ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর পাকিস্তানী ক্রিকেটে দাউদ ক্লাব, লাহোর ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলস এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্স ও ওরচেস্টারশায়ারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে খেলেছেন।
লাহোরভিত্তিক মর্যাদাসম্পন্ন এইচসন কলেজে পড়াশুনো করেন। এরপর, ইংল্যান্ডের রয়্যাল গ্রামার স্কুল ওরচেস্টারের ভর্তি হন। সেখানেই ক্রিকেট খেলায় হাতেখড়ি ঘটে। ১৯৭২ সালে অক্সফোর্ডের কেবল কলেজে অধ্যয়ন করেন। সেখান থেকে ১৯৭৫ সালে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এ সময়ে ওরচেস্টারশায়ার, নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাসেক্সে খেলেন। সাসেক্সের পক্ষে খেলাকালীন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফাস্ট বোলার জন স্নো’র সান্নিধ্যে দৌঁড়ানো ও বোলিং ভঙ্গীমার পরিবর্তন ঘটান। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ব্লুজ ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ওরচেস্টারশায়ারের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে অংশ নেন। এ পর্যায়ে মিডিয়াম-পেস বোলার হিসেবে খেলতেন।
পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খুব কমই অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শুরুরদিকে লাহোরভিত্তিক ছোট ছোট বিভিন্ন দলে খেলেছেন। এরপর, ১৯৭০-৭১ মৌসুমে প্রধান দলে অন্তর্ভুক্ত হন। লাহোরে ষোলো বছর বয়সে ১৯৭০ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে।
বিদ্যালয় জীবনে থাকাকালীন গাছ থেকে পড়ে যান ও বামহাত ভেঙ্গে যায়। এরপর তাঁকে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। বোলিংয়ে সমস্যা না হলেও বামহাতে সমস্যা দেখা দেয়। তাসত্ত্বেও, ব্যাটিং করতেন। নয় বছর বয়সেই টেস্ট ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখতেন। ষোলো বছর বয়সে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটলেও সাধারণমানের সফলতা পান। কয়েকটি খেলায় অংশগ্রহণের পরই তাঁকে পাকিস্তান দলের সদস্য করা হয়। এ সময়ে তিনি অক্সফোর্ডের ছাত্র ছিলেন। শুরুতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দাউদ ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষে ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। এরপর, ১৯৭৫-৭৬ মৌসুম থেকে ১৯৮০-৮১ মৌসুম পর্যন্ত পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের পক্ষে খেলেছিলেন।
শেষবারের মতো ঢাকায় খেলতে যান। পশ্চিম পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সদস্যরূপে ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দেন। এর পরপরই পাকিস্তানী সেনারা ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকে ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭২ সালে ইংল্যান্ডে থাকা অবস্থায় অস্ট্রেলিয়া দল খেলতে আসে। ডেনিস লিলি’র বল তাঁকে আকৃষ্ট করে ও দ্রুতগতিতে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনিই তাঁর চোখে প্রকৃত মানসম্পন্ন ফাস্ট বোলার ছিলেন যা তিনি পাকিস্তানে দেখেননি।
১৯৭১ থেকে ১৯৯২ সময়কালে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বমোট ৮৮ টেস্ট ও ১৭৫টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড সফরে আসা পাকিস্তানী দলের সদস্যরূপে যুক্ত হন। ১৮ বছর বয়সে মিডিয়াম-পেসার হিসেবে খেলতে নামেন। পরবর্তীকালে প্রকৃতমানসম্পন্ন অল-রাউন্ডারে পরিণত হন। দুই দশককাল দলের সদস্যরূপে খেলেন। এক পর্যায়ে মাঝারিমানের পাকিস্তান দলের অধিনায়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ও পরবর্তীতে দলকে বিশ্বসেরায় উপনীত করেন। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় দলকে নেতৃত্ব দেন। এমসিজিতে প্রায় ৮৯,০০০ দর্শকের সম্মুখে আইসিসি বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার শিরোপা উত্তোলন করেন। এরফলে, খেলোয়াড়ী জীবনে নতুন মোড় আনেন। বর্ণাঢ্যময় খেলোয়াড়ী জীবনের সমাপ্তি টানেন। পরিশেষে, রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন।
হানিফ মোহাম্মদের মাধ্যমে বেতারে প্রসারের পর টেলিভিশনে দর্শকদেরকে নিয়ে আসেন। হৃদয়বিহীন অবস্থায় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে খেলাকে ফিরিয়ে আনতেন। ছন্দোবদ্ধ দৌঁড়ানো ও রিভার্স সুইংয়ের সাথে ইয়র্কারকে বোলিং যুক্ত করতেন। এছাড়াও, ব্যাট হাতে দূর্দান্ত ভূমিকা রেখে অল-রাউন্ডারে পরিণত করেন। পাশাপাশি অন্য যে-কারোর তুলনায় পাকিস্তান দলকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
১৯৮০-এর দশকে টেস্ট ক্রিকেটে প্রভাব বিস্তারকারী ইংল্যান্ডের ইয়ান বোথাম, নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলি ও ভারতের কপিল দেবের সাথে বিশ্বের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডারের স্বীকৃতি লাভ করেছেন। ব্যাট হাতে ৩৭ গড়ে রান সংগ্রহ ও ২২ গড়ে উইকেট সংগ্রহ করে অল-রাউন্ডার চতুষ্টয়ের শীর্ষে অবস্থান করছেন। যেখানে ইয়ান বোথামের খেলার মান দূর্বলতর হতে থাকে, সেখানে ইমরান খান সফল থেকে সফলতম হতে থাকেন। নিজের শেষ ১০ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৫১ টেস্ট খেলে ব্যাট হাতে গড়ে ৫০ রান ও বল হাতে ১৯ গড়ে উইকেট পেয়েছেন।
নিজের স্বর্ণালী সময়ে খুব সহজেই বিশ্বমানের বোলিং, ব্যাটিংয়ে দক্ষতা ও অধিনায়ক হিসেবে উজ্জ্বীবনী শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। ১৯৭১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘদিন পাকিস্তানের পক্ষে খেলেছেন। এক কথায় ও সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটারের সম্মাননা লাভ করেছেন। গ্যারি সোবার্সের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা অল-রাউন্ডারের মর্যাদা পেয়েছেন।
কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৭১ সালে ইংল্যান্ড গমনার্থে ইন্তিখাব আলমের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলে যুক্ত হন। ৩ জুন, ১৯৭১ তারিখে বার্মিংহামের এজবাস্টনে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। তেমন সুবিধে করতে পারেননি। আসিফ মাসুদের সাথে বোলিং উদ্বোধনে নেমে কোন উইকেটের সন্ধান পাননি। খেলায় কোন উইকেট লাভে ব্যর্থ হন ও সর্বমোট ৫ রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। জহির আব্বাসের দূর্দান্ত ২৭৪ রান এবং মুশতাক মোহাম্মদ ও আসিফ ইকবালের শতরানের কল্যাণে টেস্টটি ড্রয়ে পরিণত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। তিন বছর পর প্রুডেন্সিয়াল ট্রফিতে ট্রেন্ট ব্রিজে অনুষ্ঠিত খেলায় একই দলের বিপক্ষে ওডিআইয়ে অভিষেক ঘটে। এ খেলাতেও কোন উইকেট পাননি। তবে, ১০ ওভার বোলিং করে পুরো খেলায় তৃতীয় সেরা মিতব্যয়ী বোলিংয়ের ছাঁপ রাখেন।
অভিষেকের পর থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত নিজ দেশের পক্ষে আসা-যাবার পালায় ছিলেন। সাধারণমানের ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনের পর দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেয়ার জন্যে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়। পঞ্চম টেস্টে অংশ নেয়ার জন্যে আরও দুই বছর দলের বাইরে ছিলেন। তবে, দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকায় ১৯৭৬ সাল থেকে দলে নিয়মিতভাবে খেলতে থাকেন।
অক্সফোর্ডে পড়াশোনা শেষ করার পর ও ওরচেস্টারশায়ারের মেয়াদ শেষ হলে ১৯৭৬ সালে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। ১৯৭৬-৭৭ মৌসুম থেকে দলের নিয়মিত খেলোয়াড়ে পরিণত হন। ঐ মৌসুমে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হন। অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে পুণরুজ্জীবন ঘটান। সিডনি টেস্টে পেস বোলিংয়ে অস্ট্রেলীয়দের নাস্তানুবাদ করে ছাড়েন। ঐ টেস্টে ১২ উইকেট দখল করেন ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দলকে জয় এনে দিয়ে প্রথমবারের মতো সিরিজে স্বাগতিক দলকে পিছনে ফেলে দেন।
১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে নিজ দেশে জন পার্কারের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ৩০ অক্টোবর, ১৯৭৬ তারিখে করাচীতে অনুষ্ঠিত সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। ৩/১০৭ ও ২/১০৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, চতুর্থ ইনিংসে উপর্যুপরী অনেকগুলো খাঁটোমানের বোলিং করলে শাকুর রানা ও সুজাউদ্দীন – উভয় আম্পায়ারের কাছ থেকে সতর্কবার্তা পান। এক পর্যায়ে ইনিংসের বাদ-বাকী সময় তাঁকে বোলিং করা থেকে বিরত রাখা হয়। এছাড়াও, ব্যাট হাতে ৫৯ ও ৪* রান সংগ্রহ করেছিলেন। তবে, জাভেদ মিয়াঁদাদের দ্বি-শতরানের বদৌলতে করাচীতে পাকিস্তান দল ৫৬৫ রান সংগ্রহ করে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে স্বাগতিক দল তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২-০ ব্যবধানে জয়লাভ করে।
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরেও একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ঐ সিরিজে ২৫ উইকেট পেয়েছিলেন। এ সফরের পর সত্তুরের দশকের শেষদিকে ক্যারি প্যাকারের পরিচালনায় বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে অংশ নেয়ার লক্ষ্যে টনি গ্রেগ তাঁকে খেলার জন্যে চুক্তিবদ্ধ করেন। প্রতিযোগিতার অন্যতম দ্রুতগতিসম্পন্ন বোলারের মর্যাদা পান। ঘণ্টায় ১৩৯.৭ কিলোমিটার গতিবেগে বোলিং করে ঐ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় দ্রুততম বল ছুঁড়েন। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ফলে দশ মাসের জন্যে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েন। তাসত্ত্বেও সেখানে তিনি পরিপূর্ণ অল-রাউন্ডারে পরিণত হন। পাঁচ নম্বর অবস্থানে থেকে ব্যাট হাতে মাঠে নামেন ও আউট-সুইঙ্গারে প্রভূতঃ উত্তরণ ঘটান। বিশ্ব মানসম্পন্ন বোলারদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ বোলারে পরিণত করতে সচেষ্ট হলেও মাইক প্রোক্টর তাঁকে দৌঁড়ানোর ভঙ্গীমার দিকে নজর দেয়ার পরামর্শ দেন। আউট-সুইঙ্গারকে কার্যকর করতে জন স্নো তাঁকে তাঁর বাম কাঁধের উপর ভর করে ফাইন-লেগের দিকে নিয়ে যেতে বলেন।
১৯৭৮ সালে পার্থে প্রসিদ্ধ ‘গতির যুদ্ধ’ পরীক্ষায় অংশ নেন। জেফ থমসন ও মাইকেল হোল্ডিংয়ের পর তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন যে, আমরা বাউন্সার করলেও জেফ থমসন ফুল টস ছুঁড়েছিলেন। ফলে, কিছুটা পার্থক্যের সৃষ্টি হয়; তাসত্ত্বেও, সম্ভবতঃ তিনি অধিক দ্রুতগতিসম্পন্ন ছিলেন। আট বলের সাতটিতেই আমি মাইকেল হোল্ডিংয়ের চেয়ে এগিয়েছিলাম। ঐ সময়ে আমি আমার স্বর্ণালী সময়ে ছিলাম না। পরবর্তী দুই বছরে আমি আরও দ্রুততর বোলিং করি।
১৯৮০-৮১ মৌসুমে নিজ দেশে ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বাধীন ক্যারিবীয় দলের মুখোমুখি হন। পুরো সিরিজে অসাধারণ খেলেন। ২৪ নভেম্বর, ১৯৮০ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। অপূর্ব ব্যাটিংশৈলীর স্বাক্ষর রাখেন। ১২৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ১/৩৯ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর শতকের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
একই সফরের ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৮০ তারিখে মুলতানে অনুষ্ঠিত সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে অংশ নেন। ৫/৬২ ও ০/২৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, একবার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ১০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তবে, ভিভ রিচার্ডসের অসাধারণ ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে সফরকারীরা ১-০ ব্যবধানে জয় পায়। ২০৪ রানসহ ১০ উইকেট দখল করে ভিভ রিচার্ডসের সাথে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার পান।
১৯৮১-৮২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের সর্বাধিক উইকেট শিকারীতে পরিণত হন। ফজল মাহমুদের ১৩৯ উইকেট লাভের রেকর্ড অতিক্রম করেন। ঐ একই সিরিজে তিনি প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ নির্বাচিত হন।
একই মৌসুমে নিজ দেশে বান্দুলা বর্ণাপুরা’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। ২২ মার্চ, ১৯৮২ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত সফররত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনে অগ্রসর হন। ৮/৫৮ ও ৬/৫৮ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, দলের একমাত্র ইনিংসে ৩৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর তোপে শ্রীলঙ্কা দল গুড়িয়ে যায়। ঐ খেলায় ১৪ উইকেট লাভ করলে ইনিংস ও ১০২ রানে জয় পেয়ে স্বাগতিকরা ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়।
১৯৮২ সালে স্বর্ণালী সময় অতিবাহিত করেন। ৯ টেস্টে অংশ নিয়ে ১৩.২৯ গড়ে ৬২ উইকেট দখল করেন এবং ৪৯.১২ গড়ে ৩৯৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। টেস্টের ইতিহাসে এক বছর ৫০ উইকেট লাভকারী বোলারদের মধ্যে সর্বনিম্ন গড়ের অধিকারী হন। এছাড়াও, ১৯৭৭ সালে ৪২ উইকেট ও ২৪৮ রান, ১৯৮৬ সালে ৩৩ উইকেট ও ১৬৩ রান, ১৯৮৭ সালে ২৯ উইকেট ও ৫১৫ রান এবং ১৯৮০ সালে ৩০ উইকেট ও ৩৫১ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
১৯৮২ সালে দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্বে থেকে পাকিস্তানী দলের সদস্যরূপে ইংল্যান্ড গমন করেন। পুরো সিরিজে অসামান্য ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। ২৬ আগস্ট, ১৯৮২ তারিখে লিডসে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। ৬৭* ও ৪৬ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, ৫/৪৯ ও ৩/৬৬ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও স্বাগতিকরা ৩ উইকেটে জয় পেয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ঐ সিরিজে ২১২ রান সংগ্রহসহ ২১ উইকেট দখল করে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার পান।
১৯৮২-৮৩ মৌসুমে নিজ দেশে কিম হিউজের নেতৃত্বাধীন অজি দলের মুখোমুখি হন। ১৪ অক্টোবর, ১৯৮২ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অপূর্ব ক্রীড়াশৈলীর স্বাক্ষর রাখেন। ৪/৪৫ ও ৪/৩৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ব্যাট হাতে ৩৯* রান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর অনবদ্য অল-রাউন্ড ক্রীড়া নৈপুণ্যের কল্যাণে স্বাগতিকরা ৯ উইকেটে জয় পেলে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
একই মৌসুমে সুনীল গাভাস্কারের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের মুখোমুখি হন। ১৯৮২ সালে নিজ দেশে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে ছয়-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজ থেকে ১৩.৯৫ গড়ে ৪০ উইকেট পেয়েছিলেন। ঐ সিরিজে তাঁর দল ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করলে উৎফুল্ল ক্রিকেট সমর্থকেরা তাঁকে জঙ্গী বিমানের নাম ধরে ডাকতে শুরু করে। ঐ সময় পাকিস্তান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফ-সিক্সটিন জঙ্গী বিমান পায়। পাশাপাশি, হাঁড়ে ফাঁটল ধরায় বোলিং করতে পারেননি ও দুই বছরের অধিক সময় নষ্ট করেন।
৩ জানুয়ারি, ১৯৮৩ তারিখে ফয়সালাবাদে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। ১১৭ রানের শতক হাঁকানোর পাশাপাশি ৬/৯৮ ও ৫/৮২ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। এরফলে, অ্যালেন ডেভিডসন ও ইয়ান বোথামের পর তৃতীয় অল-রাউন্ডার হিসেবে টেস্টে শতক ও ১০ উইকেট লাভের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। পরবর্তীতে, নভেম্বর, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান খুলনায় সফরকারী জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৪৩ রান সংগ্রহসহ ৫/৮০ ও ৫/৪৪ বোলিং পরিসংখ্যান গড়ে তাঁদের এ তালিকায় স্বীয় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১২১ বল মোকাবেলান্তে ১৯২ মিনিটে দশটি চার ও পাঁচটি ছক্কায় শতরানের ইনিংস খেলেন। এ পর্যায়ে তিনি দলের প্রথমবারের মতো এক ইনিংসে চারটি শতকের একটি শতরানের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। তন্মধ্যে, কপিল দেবের এক ওভার থেকে ২১ (৬৪০৪৬১) রান তুলেছিলেন। তাঁর অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ১০ উইকেটে জয় পেলে ছয়-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
আঘাতের কারণে ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় ব্যাটসম্যান হিসেবে অংশ নেন। পেশীতে টান ও পরবর্তীতে হাঁড়ে ফাটল দেখা দিলেও সর্বদাই বোলার হিসেবে মাঠে নেমেছেন। পেস হারালেও ধরন পরিবর্তন, রিভার্স সুইংয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে যান। ব্যাটিংয়ের মাঝেও নির্ভরযোগ্যতার ছাঁপ পরিলক্ষিত হয়।
১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে পুণরায় খেলার জগতে ফিরে আসেন। ১৯৮৫ সালে পুণরায় বোলিং করতে শুরু করেন। ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নিউ সাউথ ওয়েলসের পক্ষে খেলাকালীন ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সার্ধ্বশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে এমসিজিতে বিশ্ব ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপে পাকিস্তানের সাথে যোগ দেন।
১৯৮৫-৮৬ মৌসুমে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে শ্রীলঙ্কা গমন করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ তারিখে ক্যান্ডি’র অ্যাসগিরিয়া স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। ৩/২০ ও ২/২৯ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তন্মধ্যে, সিদ্ধার্থ ওয়েতিমুনিকে বিদেয় করে খেলার প্রথম উইকেট লাভ করলে তিনি ২৫০ উইকেট লাভের মাইলফলক স্পর্শ করেন। পাশাপাশি, দ্বিতীয় ইনিংসের এক পর্যায়ে উপর্যুপরী তিনটি ওয়াইড বল ছুঁড়েছিলেন। এছাড়াও, দলের একমাত্র ইনিংসে ৭ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তবে, তৌসিফ আহমেদের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ২০ রানে জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে নিজ দেশে ভিভ রিচার্ডসের নেতৃত্বাধীন ক্যারিবীয় দলের মুখোমুখি হন। পুরো সিরিজে দূর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। ২০ নভেম্বর, ১৯৮৬ তারিখে করাচীতে অনুষ্ঠিত সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। দলনায়কের দায়িত্বে থেকে অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনে অগ্রসর হন। ২/৩২ ও ৬/৪৬ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর অসামান্য বোলিংশৈলীর কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও ১-১ ব্যবধানে সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান। এছাড়াও, ১১৫ রান সংগ্রহসহ ১৮ উইকেট দখল করে ম্যালকম মার্শালের সাথে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার পান।
একই মৌসুমে ভারত এবং ১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের প্রথম সিরিজ বিজয়ে নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তানী দলকে নিয়ে ভারত গমন করেন। ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ তারিখে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। ১৩৫* রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, ২/১০৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। কৃষ শ্রীকান্তের সাথে যৌথভাবে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
হেডিংলিতে ৭৭ রান খরচায় ১০ উইকেট দখল করেছিলেন। এ পর্যায়ে ৪ জুলাই, ১৯৮৭ তারিখে হেডিংলি টেস্টে উইকেট-রক্ষক জ্যাক রিচার্ডসকে ইজাজ আহমেদের তালুবন্দীতে পরিণত করে ৩০০ উইকেট লাভের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। ইনিংস ও ১৮ রানে দল জয় পায় ও তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পান। পরবর্তীতে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ বিজয় করে। এছাড়াও, ঐ সিরিজে ওয়াসিম আকরামের চেয়ে ৫ উইকেট বেশী নিয়ে ২১ উইকেট লাভ করে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন।
১৯৮৭ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান একাদশের বিপক্ষে প্রস্তুতিমূলক খেলায় পাকিস্তানী একাদশের অধিনায়কত্ব করেন। প্যাড ও টুপি পরিহিত অবস্থায় স্মিতহাস্যে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে মাঠে নামলে পরবর্তী করণীয় হিসেবে তিনি দ্রুততার সাথে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেন। একই বছর বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। তবে, পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউল হকের একান্ত অনুরোধক্রমে ১৯৮৮ সালে পুণরায় অবসর থেকে ফিরে আসেন। এরপর, ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরে পাকিস্তান দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কিছু স্মরণীয় লড়াইয়ের সাথে লিপ্ত হন ও কোন ছাড় দেননি। তিনটি সিরিজ ড্র করতে সমর্থ হন। এ পর্যায়ে অন্যান্য সকল দলই এ সাফল্যের বাইরে ছিল। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে সর্বকালের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সিরিজটি ১-১ ব্যবধানে শেষ হয়। নিজ দেশে ফিরে টেস্ট ক্রিকেটে তৃতীয় দেশের আম্পায়ার নিয়োগের বিষয়ে মত প্রকাশ করেন। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চার-টেস্ট নিয়ে গড়া ড্র হওয়া সিরিজে ইংল্যান্ডের জন হ্যাম্পশায়ার ও জন হোল্ডার আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে পাকিস্তানী দলকে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ তারিখে ওয়েলিংটনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। চমৎকার ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। ৩/৭৫ ও ৩/৩৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, একমাত্র ইনিংসে ৭১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন স্বত্ত্বেও খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটির একটি পরিত্যক্ত হলে অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়।
একই সফরের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে ব্যক্তিগত সাফল্যের সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ৬৯ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৩০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ৬৯* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ১/৭৬ ও ০/১৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, জাভেদ মিয়াঁদাদের অসাধারণ ব্যাটিংয়ের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ফলাফলবিহীন অবস্থায় শেষ হয়।
১৯৯১-৯২ মৌসুমে নিজ দেশে অরবিন্দ ডি সিলভা’র নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কান দলের মুখোমুখি হন। ২ জানুয়ারি, ১৯৯২ তারিখে ফয়সালাবাদে অনুষ্ঠিত সফররত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে অংশ নেন। কোন ইনিংসেই বোলিং করেননি ও শেষ ইনিংসে ব্যাট হাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ২২ ও ০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তাসত্ত্বেও, ওয়াসিম আকরামের চমৎকার অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে দল ৩ উইকেটে জয়লাভের পাশাপাশি তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করতে সমর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে অংশগ্রহণ ছিল।
৩০ বছর বয়সে জাভেদ মিয়াঁদাদের পরিবর্তে অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন। ৪৮ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ১৪টিতে জয় ও ৮টি পরাজিত হয় তাঁর দল। এছাড়াও, ১৩৯টি ওডিআইয়ে দলকে পরিচালনা করে ৭৭বার জয় ও ৫৭টিতে পরাজিত হয়।
৩৯ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় সফলতার সাথে পাকিস্তানের শিরোপা বিজয়ে নেতৃত্ব দেন। এ প্রতিযোগিতায় বলের তুলনায় ব্যাট হাতেই অধিক ভূমিকা রেখেছিলেন। দলের ব্যাটিং বিভাগ দূর্বলতর থাকায় সম্মুখের দিকে নিজের অবস্থান গড়েন। ৮ খেলা থেকে ৩০ ঊর্ধ্ব গড়ে ১৮৫ রান ও ৭ উইকেট পেয়েছিলেন। শিরোপা লাভের পরপরই নিজের অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। শিরোপা হাতে নেয়ার পর ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা বলেন।
১৯৮৪ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মাতা শওকত খানমের মৃত্যু ঘটে। এরপর থেকেই তিনি স্বীয় মাতার নামে ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালান ও পাকিস্তানের দরিদ্র রোগীদের জন্যে বিনামূল্যে সেবাদানের কথা ঘোষণা করেন। এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় আর্থিক তহবিল গঠন করে তিনি ৫০ লক্ষ রূপী পান। পাকিস্তান সরকারও তাঁর উদ্যোগকে স্বাগতঃ জানায় ও লাহোরের শহরতলীতে ২০ একর ভূমি দান করে। এক দশক অবিরাম চেষ্টার ফসল হিসেবে ঐ হাসপাতালের উদ্বোধন ঘটে।
নিজস্ব ৭৫তম টেস্টে ৩০০ উইকেট ও ৩০০০ রান সংগ্রহের ন্যায় ‘ট্রিপল’ লাভের অধিকারী হন। পরিসংখ্যানগতভাবে ইয়ান বোথামের পর ৩ টেস্ট বেশী খেলে দ্বিতীয় দ্রুততম এ রেকর্ডের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ড সফরের পর শেষ ৫১ টেস্ট থেকে ৫১.৬০ গড়ে ২৪৭৭ রান ও ১৯.৯০ গড়ে ২০৪ উইকেট তুলেন। সব মিলিয়ে টেস্টে ৩৭.৬৯ গড়ে ৩৮০৭ রান ও ২২.৮১ গড়ে ৩৬২ উইকেট দখল করেছিলেন। টেস্টের ঊনিশজন শীর্ষ অল-রাউন্ডারের অন্যতম হিসেবে ২০০ উইকেট ও ৩০০০ রানের ন্যায় ‘ডাবল’ লাভের অধিকারী। সমসাময়িকদের কাছ থেকে সেরা অল-রাউন্ডারের পরিচিতি অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যান। দেশের অধিকাংশ নাগরিকই তাঁকে পাকিস্তানের সেরা অধিনায়কের আসনে বসায়। জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত করে।
অবসর গ্রহণের পরও উচ্চ খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজের পরিচিতি ঘটাতে সচেষ্ট ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। জেমিমা গোল্ডস্মিথের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেও পরবর্তীতে বিবাহ-বিচ্ছেদে পরিণত হয়। পরবর্তীতে, বুশরা মানিকা নাম্নী এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেন। সুলাইমান ঈসা খান ও কাসিম খান নামীয় দুই পুত্র সন্তানের জনক। সর্বাপেক্ষা খ্যাতিসম্পন্ন ক্রিকেটার হিসেবে পরবর্তীকালে পাকিস্তানী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৭ আগস্ট, ২০১৮ তারিখে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের সাধারণ নির্বাচনে সর্বাধিক আসনে বিজয়ী হলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।
তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন নিষ্কলুষ ছিল না। ১৯৮১ সালে কাউন্টি খেলায় বোতলের ছিপি ব্যবহারে বলে আঁচড় কাটেন। ১৯৯৬ সালে ইংল্যান্ডের সাবেক দুই ক্রিকেটার – ইয়ান বোথাম ও অ্যালান ল্যাম্বের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ আনলে তিনি মামলায় বিজয়ী হন। ১৯৯৭ সালে লস অ্যাঞ্জলসের আদালত থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে টাইরিয়ান হোয়াইট নাম্নী চার বছরের অবৈধ সন্তানের পিতা হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮৩ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৮৫ সালে সাসেক্স ক্রিকেট সোসাইটি কর্তৃক বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে তাঁকে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল। আইসিসি’র শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে ২০১০ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত পঞ্চান্নজনের উদ্বোধনী তালিকায় তাঁকে যুক্ত করা হয়। এছাড়াও, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড প্রণীত পাকিস্তান ক্রিকেট হল অব ফেমের উদ্বোধনী তালিকায় হানিফ মোহাম্মদ, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস ও জহির আব্বাসের সাথে অন্তর্ভুক্ত হন।