৭ আগস্ট, ১৯৪৮ তারিখে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার আনলে এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, প্রশাসক ও কোচ। মূলতঃ শীর্ষসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে মিডিয়াম কিংবা লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
নিজের সেরা দিনগুলোয় নান্দনিক ও দর্শনীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। প্রতিপক্ষীয় খেলোয়াড়দের কাছে দুর্বোধ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতাসুলভ ও ক্রিকেটের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্রে নিজের পরিচিতি ঘটিয়েছেন। ডন ব্র্যাডম্যানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ক্রিকেটের সর্বাধিক বর্ণাঢ্যময় খেলোয়াড় ডন ব্র্যাডম্যানের খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করার ১১ দিন পূর্বে গ্রেগ চ্যাপেলের জন্ম। মার্টিন ও জিন চ্যাপেল দম্পতির দ্বিতীয় সন্তানরূপে তাঁর জন্ম। মাতা সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সেরা অল-রাউন্ডার ও ডন ব্র্যাডম্যানের দলীয় সঙ্গী ভিক রিচার্ডসনের কন্যা ছিলেন। সাড়ে তিন দশক পর এ শিশুটিই নিজস্ব ৮৭তম ও সর্বশেষ টেস্টে অংশ নিয়ে ডন ব্র্যাডম্যানের সংগ্রহকে ছাঁপিয়ে যান। কিংবদন্তীতুল্য খেলোয়াড়ের পর তিনি অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যানের মর্যাদা লাভ করেন।
গ্রেগ চ্যাপেল কর্তৃক স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সংগ্রহকে ছাঁপিয়ে যান। প্রথম অস্ট্রেলীয় হিসেবে ৭০০০ টেস্ট রান সংগ্রহকে মূল্যায়িত করতে ডন ব্র্যাডম্যান মন্তব্য করেন যে, ‘সন্দেহাতীতভাবে তিনি এ সম্মানের দাবীদার। অনেকগুলো বছর ধরে তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধান ব্যাটসম্যান হিসেবে চিত্রিত হয়ে আছেন। গর্বের সাথে বলতে পারি যে, অস্ট্রেলিয়া দলে তাঁকে অন্তর্ভুক্তকালীন আমি দল নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম।’ ক্যারি প্যাকারের ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেট চলাকালীন তরুণ ব্যাটসম্যান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
১.৮৭ মিটার উচ্চতার অধিকারী। অ্যাডিলেডভিত্তিক প্রিন্স আলফ্রিড কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৬৫ সালের গ্রীষ্মে আকস্মিকভাবে তিন ইঞ্চি উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে দীর্ঘদেহী, লিকলিকে গড়ন নিয়ে পরবর্তী দুই দশক প্রবল প্রতাপে মাঠে রাজত্ব কায়েম করেন। আকস্মিক বৃদ্ধিতে কৈশোরের দিনগুলোয় লেগ-স্পিনে খেঁই হারিয়ে ফেলেন। এগুলো কিছু কার্যকর মিডিয়াম-পেস বোলিংয়ে রূপান্তর করে। এছাড়াও, বিদ্যালয় ক্রিকেটে বিশাল অঙ্কের রান তুলতে শুরু করেন। বিদ্যালয়ের শেষ খেলায় মারমুখী শতক হাঁকালে বিদ্যালয় কোচ চেস্টার বেনেটের পরামর্শক্রমে বিখ্যাত ব্যক্তির নজরে পড়েন। এ পর্যায়ে তিনি অফ-সাইডের বলগুলোকে অবলীলাক্রমে ওয়াইড মিড-অন অঞ্চল দিয়ে খেলতে থাকেন। সহজাত খেলায় বিঘ্ন হবে বিধায় কোচ কোন বার্তা পাঠাননি।
১৯৬৬-৬৭ মৌসুম থেকে ১৯৮৩-৮৪ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে কুইন্সল্যান্ড ও সাউথ অস্ট্রেলিয়া এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে সমারসেটের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তন্মধ্যে, ১৯৬৮ সালে সমারসেটের ক্যাপ লাভ করেন।
ডিসেম্বর, ১৯৬৭ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সদস্যরূপে সফরকারী ভারতীয় একাদশের বিপক্ষে খেলেন। সাজঘরের সামনে তিনি ব্যাটিং চর্চাকালীন ডন ব্র্যাডম্যান অপরাপর খেলোয়াড়দের সাথে চা পানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আঠারো বছর বয়সী খেলোয়াড়ের সামনে থামেন। ‘আমি যদি তুমি হতাম, তাহলে হাতল ধরার ভঙ্গীমা পরিবর্তন করতাম।’ তাঁকে তিনি ‘দি আর্ট অব ক্রিকেট’ পুস্তক পড়ার কথা বলেন। ‘পূর্বে যেহেতু ব্যবহার করনি তাই তোমার জন্যে অস্বস্তি হবে, কিন্তু এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে অফ-সাইডে ভালো খেলতে পারবে।’ অল্প দূরত্ব থেকে ফিরে এসে তিনি তাঁকে বলেন, এ পরামর্শটুকু কিন্তু অন্য খেলোয়াড়ের জন্যে প্রযোজ্য। ঐদিন তিনি এভাবে হাতল ধরে খেলেন ও ৫৫ রান তুলেন। পূর্বেকার খেলার ধরনকে ফিরিয়ে না এনে নতুন পদ্ধতিতে টেস্টে ৭১১০ রান তুলেছিলেন।
১৯৭০ থেকে ১৯৮৪ সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বমোট ৮৭ টেস্ট ও ৭৪টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭০-৭১ মৌসুমে নিজ দেশে রে ইলিংওয়ার্থের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭০ তারিখে পার্থে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। দলের সংগ্রহ ১০৭/৫ থাকাকালে তিনি মাঠে নামেন। ষষ্ঠ উইকেটে ইয়ান রেডপথের সাথে ২১৯ রানের জুটি গড়ে দলের বিপর্যয় রোধ করতে অগ্রসর হন। ২১৮ বল মোকাবেলা তিনি ১০৮ রান তুলেছিলেন। একবার ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ১/৫৪ ও ০/১৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে ছয়-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ফলাফলবিহীন অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে ইয়ান চ্যাপেলের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ১ মার্চ, ১৯৭৪ তারিখে ওয়েলিংটনে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন। কয়েকটি ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। প্রথম ইনিংসে ১৩২ রানে পৌঁছানোকালে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ রান অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে প্রথম ইনিংসে ১২৬ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ১৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ২৪৭* ও ১৩৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। ঐ খেলায় তিনি মোট ৩৮০ রান তুলে তৎকালীন যে-কোন অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানের সর্বমোট রানের রেকর্ড গড়েন। পরবর্তীতে, ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে মার্ক টেলর পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪২৬ রান তুলে তাঁর সংগ্রহকে ছাঁপিয়ে যান। ঐ একই টেস্টে তাঁর ভ্রাতা ইয়ান চ্যাপেল উভয় ইনিংসে শতক (১৪৫ ও ১২১) হাঁকিয়েছিলেন। একমাত্র ঘটনা হিসেবে দুই দলীয় সঙ্গীর একই টেস্টে জোড়া শতকরূপে নিজেদের চিত্রিত করেন। পরবর্তীতে, ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে সাদিক মোহাম্মদ (১০৩*) ও মুশতাক মোহাম্মদ (১০১) রানে রান-আউটে বিদেয় নিলে টেস্টের একই ইনিংসে শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন। প্রথম ইনিংসে ইয়ান চ্যাপেলের সাথে তৃতীয় উইকেটে ২৬৪ রানের জুটি গড়েন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। পাশাপাশি, ০/২৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
এক পর্যায়ে ১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে সহোদর ইয়ান চ্যাপেলের কাছ থেকে দলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেয়ার প্রথম টেস্টেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে উভয় ইনিংস শতক (১২৩ ও ১০৯*) হাঁকান। ঐ খেলায় তাঁর দল আট উইকেটে জয় পায় ও ৫-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে। ১৯৭৬ সালে বর্ষসেরা অস্ট্রেলীয় ক্রীড়াবিদ হিসেবে মনোনীত হন। পরবর্তীতে, বিরাট কোহলি তাঁর এ সাফল্যের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। তাঁর অধিনায়কত্বে অস্ট্রেলিয়া দল ৪৮ টেস্টের ২১টিতে জয় পায়। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রথম ও শেষ টেস্টে শতরান করেছিলেন।
১৯৮১-৮২ মৌসুমে অজি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ১৯ মার্চ, ১৯৮২ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে দূর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। ১৭৬ ও ৩* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ১/৩০ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ৮ উইকেটে জয়লাভ করলে সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে নিজ দেশে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের মুখোমুখি হন। ২ জানুয়ারি, ১৯৮৪ তারিখে সিডনিতে অনুষ্ঠিত সফররত পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। ১৮২ রানের ইনিংস খেলে স্বাগতিক দলকে খুব সহজেই জয় এনে দেন। তাঁর অসাধারণ শতকের কল্যাণে স্বাগতিকরা ১০ উইকেটে জয় পেলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজে জয়লাভ করে। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
ক্যারি প্যাকারের ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে অংশ নেন। এ প্রতিযোগিতা থেকে ফিরে আসার পর পুণরায় অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমের অ্যাশেজ সিরিজ বিজয়ে নেতৃত্ব দেন। অধিকাংশ টেস্টেই প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। কেবলমাত্র দুইবার ১৯৭৫ সালে ইংল্যান্ডে ও ১৯৮১-৮২ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তেমন সুবিধে করতে পারেননি।
টেস্টগুলো থেকে ২৪ শতক সহযোগে ৫৩.৮৬ গড়ে ৭১১০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ৪০.৭০ গড়ে ৪৭ উইকেট দখল করেছিলেন। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫২.২০ গড়ে ২৪৫৩৫ রান ও ২৯.৯৫ গড়ে ২৯১ উইকেট পেয়েছিলেন।
১৯৭৩ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। ২০০০ সালে শতাব্দীর সেরা অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে ঠাঁই পান। ৯ ডিসেম্বর, ১৯৮৬ তারিখে স্পোর্ট অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০০২ সালে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট হল অব ফেমে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের পর কোচ ও ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা পর্যন্ত দুই বছর ভারত দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। দল নির্বাচকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ন্যাশনাল ট্যালেন্ট ম্যানেজার হিসেবে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে ভূমিকা রাখছেন। এছাড়াও, সাউথ অস্ট্রেলিয়ার কোচ ছিলেন। ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৯ সালে এমবিই উপাধিতে ভূষিত হন। ২০২১ সালে অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া লাভ করেন।
দাতব্য সংগঠনে জড়িয়ে রয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। চ্যাপেল জুডি নাম্নী এক রমণীর পাণিগ্রহণ করেন।