Skip to content

ডন ব্র্যাডম্যান

1 min read

২৭ আগস্ট, ১৯০৮ তারিখে জন্মগ্রহণকারী নিউ সাউথ ওয়েলসের ছোট্ট, অপরিচিত শহর কুটামুন্ড্রা এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার, লেখক ও প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে দক্ষ ছিলেন। পাশাপাশি মাঝে-মধ্যে উইকেট-রক্ষণে অগ্রসর হতেন। অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কুটামুন্ড্রায় জন্মগ্রহণ করলেও শৈশবকাল বাউরেলে অতিবাহিত করেন। বাউরেল ইন্টারমিডিয়েট হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেছেন। ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী। ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বাধিক প্রভাববিস্তারকারী ব্যাটসম্যান ছিলেন ও সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯২০-এর দশক থেকে ১৯৪৯ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব-পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচিত বীরে পরিণত হয়েছিলেন। প্রায়শঃই বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে চিত্রিত হয়ে থাকেন। ‘দ্য ডন’ ডাকনামে পরিচিত ছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান। পরবর্তী চল্লিশ বছর নিভৃতচারী হিসেবে ব্যবসায় পরিচালনা করতেন। পাশাপাশি, পারিবারিক সান্নিধ্য, গল্ফ, বাগান, ব্রিজ ও পিয়ানো বাজাতেন। শেষ দশ বছরে তাঁর খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হওয়া প্রজন্মের কাছে দেবতাতুল্য প্রতীকিতে পরিণত হন। জীবনের শুরুতে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল।

‘দ্য ডন’ বেশ জটিল প্রকৃতির ছিলেন, বেশ প্রভাব বিস্তার করতেন এবং তিনি গভীর অনুরাগী ছিলেন ও ক্রিকেটের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা ছিল। জাতীয় প্রতীকিতে পরিণত হন। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড তাঁকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত অস্ট্রেলীয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। প্রতিযোগিতা থেকে তিনি অনেক অনেক দূরে এগিয়েছিলেন ও তুলনা করা অর্থহীন হয়ে পড়ে। ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি ক্রিকেটের ইতিহাসকে পরিবর্তিত করে ফেলেন। অনেকগুলো রেকর্ডই অদ্যাবধি অক্ষত রয়ে গেছে।

রানের ফুলঝুড়ি এমনভাবে ছোটাতে থাকেন যে রান সংগ্রহের প্রবৃত্তি ও দক্ষতা ইতোপূর্বে কিংবা পরবর্তীকালে আর দেখা যায়নি। ১৯২৯ সালের বৈশ্বিক মহামন্দায় জর্জরিত জাতির একমাত্র আশা-আকাঙ্কার প্রতীকি চিত্রে পরিণত হন। ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম একনিষ্ঠ ও প্রভাব বিস্তারকারী খেলোয়াড়ের মর্যাদা লাভ করেছেন। প্রথম বিখ্যাত ক্রিকেট তারকা হিসেবে বিপুল আর্থিক সফলতা পান। রান সংগ্রহের পাশাপাশি সুনাম কুড়াতে থাকেন। এক পর্যায়ে অধিনায়কের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। প্রশাসক হিসেবেও যথেষ্ট সফল হন। ক্যারি প্যাকারের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা প্রবর্তনের পূর্বে দৃঢ়ভাবে দলকে এক সূতোয় বেঁধে রেখেছিলেন।

মূখ্যতঃ ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর ব্যাটিংয়ের কল্যাণে ক্রিকেট খেলার গতিধারা পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ মনোবল ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি হতবিহ্বল হয়ে পড়তো। তবে, তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরন ধ্রুপদীশৈলীর অধিকারী না হলেও সর্বদাই চিত্তাকর্ষক ছিল। ক্রিকেট বিশ্বে তাঁর অবদানের ফলে সন্দেহাতীতভাবে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছেন। অবিশ্বাস্য অবদানের ফলে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক ও পরিচিতি ব্যাপক বৃদ্ধি পায় এবং ‘মাতৃ দেশ’ নামে ডাকা হতো।

একাকী খেলায় ব্যাট হাতে প্রভূত্ব ঘটানো কিংবা একাকী খেলাকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তাঁর সমালোচকদের প্রশ্নবিদ্ধতা সত্ত্বেও অদ্যাবধি ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে সন্দেহাতীতভাবে নিজেকে তুলে ধরে রেখেছেন। অবসর গ্রহণসহ বয়সের সাথে সাথে তাঁর কিংবদন্তীর কথা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ পর্যায়ে অন্য যে-কারো তুলনায় তাঁকে নিয়ে লেখা গল্পগুলোর প্রায় সবগুলোই সত্যি। ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম পূজনীয় খেলোয়াড়ে পরিণত হন।

কেবলমাত্র স্ট্যান ম্যাককাবে তাঁকে সেরা হিসেবে মানতে রাজী ছিলেন না। তিনি মন্তব্য করেন যে, ‘তাঁর ন্যায় আমিও ব্যাট করতে পারি’। ১৯৩৮ সালে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে ম্যাককাবের ২৩২ রানকে ডন ব্র্যাডম্যান যথেষ্ট মূল্যায়িত করেছিলেন ও ডব্লিউ.জি’র ‘আমাকে আর্থার দাও’ বাক্যের সাথে দাঁড় করানো যেতে পারে। কেবলমাত্র দুইজন বোলারকে সমীহ করে চলতেন। ক্ল্যারি গ্রিমেট লেগ-ব্রেক ও গুগলিতে হিমশিম খাওয়াতেন এবং হ্যাডলি ভেরিটি ইংল্যান্ডের পক্ষে আটবার ও সব মিলিয়ে দশবার তাঁকে বিদেয় করেছিলেন। এছাড়াও, বিল ও’রিলি, ইয়ান পিবলস ও ওয়াল্টার রবিন্সকে সেরা বোলার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

‘ভদ্রলোকদের খেলা’ নামে পরিচিত ক্রিকেট খেলায় অস্ট্রেলিয়া তথা বিশ্বের সেরা তারকা ক্রিকেটারের মর্যাদা পেয়েছেন। ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছেন। এ সময়ে তাঁর সাথে তুলনা করা অর্থহীনতার শামিল হিসেবে বিবেচিত হতো। একটিমাত্র সিরিজ থেকেই তুলেছিলেন ৯৭৪ রান। তন্মধ্যে, হেডিংলি টেস্টের একদিনেই ৩০৯ রান তুলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাতটি টেস্ট সিরিজে একাধিপত্য বজায় রাখেন। কেবলমাত্র একবারই ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে দলটি সিরিজে পরাজিত হয়েছিল। ধ্বংসাত্মক বোলিংয়ের আধিপত্য নামে পরিচিত ‘বডিলাইন সিরিজের’ ন্যায় নিষ্ঠুর ও অখেলোয়াড়ীসূলভ আচরণ ইতিহাসের পর্দায় ঠাঁই করে নিলেও তিনি ঠিকই ঐ সিরিজে ৫৬.৫৭ গড়ে রান পেয়েছিলেন।

যে-কোন মানদণ্ডে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ক্রিকেটারের সম্মাননা লাভ করেছিলেন। তাঁর পূর্বে কেবলমাত্র ডব্লিউজি গ্রেস এ ক্রীড়াদের সেরাদের কাতারে ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর অর্ধ-শতকের অধিক সময় জীবিত ছিলেন ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেহাবসান ঘটে। শুধুমাত্র বিশ্ব মানসম্পন্ন খেলোয়াড় হিসেবেই পরিচিতি পাননি; বরঞ্চ এ সময়ে বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রশাসক, দল নির্বাচক ও সত্যিকারের ক্রিকেট জ্ঞানের অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন।

গল্ফ বল ব্যবহার করতেন। বাড়ীর পিছনে ইট দিয়ে ঘেরা পানির চৌবাচ্চার দেয়ালে বিভিন্ন কৌণিকে উচ্চগতিতে বলকে ফেলে মনোনিবেশসহ সময়কে নিয়ন্ত্রণ করে অগ্রসর হতেন। শুরু থেকেই ক্রিকেটের দিকে গভীরভাবে মনোযোগী ছিলেন ও সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। পাশাপাশি ব্যতিক্রমী সহজাত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সর্বক্রীড়ায় পারদর্শী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ান স্কোয়াশ চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জয় করেন। প্রায়শঃই বলা হয়ে থাকে যে, স্কোয়াশ, টেনিস, টেবিল টেনিস, গল্ফ কিংবা বিলিয়ার্ডেও শিরোপাধারী খেলোয়াড়ের মর্যাদা পেতেন। তবে, ঐ সকল খেলাকে পাশ কাটিয়ে ক্রিকেটের প্রতিই অনুরক্ত হয়ে পড়েন।

১১ বছর বয়সে বাউরেলে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট খেলায় অংশ নেন। ওভাল মাঠে তিনি ৫৫ রান তুলেছিলেন। বর্তমানে ঐ মাঠটি ব্র্যাডম্যান ওভাল নামে পরিচিত। ১২ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো শতরানের ইনিংস খেলেন। ১৯২১ সালে তাঁর পিতা জর্জ ব্র্যাডম্যান টেস্ট খেলা দেখার জন্যে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে নিয়ে যান। চার্লি ম্যাকার্টনি’র ১৭০ রানের ইনিংস দেখার পর তিনি তাঁর পিতাকে বলেছিলেন যে, ‘এই মাঠে না খেলা পর্যন্ত আমি খুশী হবো না।’

এক পর্যায়ে বিদ্যালয় ও স্থানীয় ক্লাবে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। প্রায় নিয়মিতভাবে শতরানের ইনিংস খেলতেন। খুব শীঘ্রই নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট সংস্থা থেকে এসসিজিতে অনুশীলন করার জন্যে আমন্ত্রণ বার্তা লাভ করেন। সেন্ট জর্জের সাথে সফলতম মৌসুম অতিবাহিত করার পর নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজ্য দলের পক্ষে খেলার জন্যে মনোনীত হন।

১৯২৭-২৮ মৌসুম থেকে ১৯৪৮-৪৯ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম শ্রেণীর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলস ও সাউথ অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত নিউ সাউথ ওয়েলস এবং সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত খেলেছেন। ১৯২৭ সালে অ্যাডিলেড ওভালে নিউ সাউথ ওয়েলসের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবনের সূত্রপাত ঘটান। শীল্ডের প্রথম খেলাতেই ১১৮ রানের দৃষ্টিনন্দন ইনিংস উপহার দেন। ১৯৪৯ সালে ঐ একই মাঠে খেলোয়াড়ী জীবনের শেষের দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলেন। নিজ দেশে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলার জন্যে খুব শীঘ্রই তাঁকে জাতীয় দলে ঠাঁই দেয়া হয়।

১৯২৮ থেকে ১৯৪৮ সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বমোট ৫২ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯২৮-২৯ মৌসুমে নিজ দেশে পার্সি চ্যাপম্যানের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ৩০ নভেম্বর, ১৯২৮ তারিখে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। বার্ট আয়রনমোঙ্গারের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। তবে, খেলায় তেমন সুবিধে করতে পারেননি। সবমিলিয়ে মাত্র ১৯ রান তুলতে পেরেছিলেন। খেলায় তিনি ১৮ ও ১ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। ৬৭৫ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হলে তাঁর দল পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।

ঐ মৌসুমের প্রথম অ্যাশেজ সিরিজে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হলেও বেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অবস্থায় খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। দূর্বল খেলা প্রদর্শন করলেও পুণরায় সদর্পে খেলার জগতে ফিরে আসেন। আট ইনিংস থেকে দুইটি শতক ও দুইটি অর্ধ-শতকের ইনিংস খেলেন। প্রায় ৬৭ গড়ে ঐ সিরিজে ৪৬৮ রান সংগ্রহ করেছিলেন।

সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিকেটকে মহিমান্বিত করে গেছেন। দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনে টেস্টে তিনি ব্যাটিং গড়কে অসম্ভব উঁচুতে নিয়ে যান। ২২ বছর হবার পূর্বেই অনেকগুলো বড় ধরনের রান করে রেকর্ড বহিতে ঠাঁই করে নেন। ২০ বছরের খেলোয়াড়ী জীবনে পরিসংখ্যানগত অর্জনগুলো বেশ উচ্চ পর্যায়ের ছিল।

১৯৩০ সালে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ড সফরে স্বীয় প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটান ও একাধিপত্য বিস্তারে তৎপরতা দেখান। ঐ সিরিজে ১৩৯.১৪ গড়ে ৯৭৪ রান সংগ্রহ করেন। দুইটি দ্বি-শতরানের ইনিংস খেলেন ও ব্যক্তিগত সেরা ৩৩৪ রান তুলে তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড গড়েন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান তোলার পাশাপাশি কয়েক দশক শীর্ষে ছিল। একসময় একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে দুইবার ত্রি-শতক হাঁকান। পরবর্তীতে অবশ্য ব্রায়ান লারা, বীরেন্দ্র শেওয়াগ তাঁর এ কৃতিত্বের সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করেছিলেন।

লর্ডসে নিজস্ব প্রথম টেস্ট খেলায় স্বাগতিকদের বিপক্ষে ২৫৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ড দল ৪২৫ রান তুললে উপস্থিত দর্শকেরা এ প্রতিভাবান অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানের ক্রীড়াশৈলী সম্পর্ক অবহিত হয়। ২১ বছর বয়সে তিন নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৭৬ বল মোকাবেলান্তে ২৫ চার সহযোগে এ রান তুলে দলকে ৭২৯/৬ করে ইনিংস ঘোষণায় অগ্রসর হয়। এ সময়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তৎকালীন অপরাজিত ৪৫২ রানের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডের অধিকারী ছিলেন।

পরবর্তীকালে নিজ আত্মজীবনী ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ গ্রন্থে এ ইনিংস সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, ‘বাস্তবিক অর্থে কোনরূপ প্রত্যাশা ছাড়াই প্রতিটি বল যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানে গিয়েছে।’ ৭০ বছরের অধিক সময় বিদেশী ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের স্বীকৃতি পায় ও প্রথমবারের মতো লর্ডস অনার্স বোর্ডে স্বীয় নামকে যুক্ত করে রাখেন। পরবর্তীতে, ২০০৩ সালে ক্রিকেটের স্বর্গভূমিতে গ্রায়েম স্মিথ ২৫৯ রান তুলে তাঁকে টপকে যান। সিরিজে তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকার বিষয়টি বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তী বছরগুলোয়ও খেলার ব্যাটিংশৈলী অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন।

ব্যাটিংয়ে নেমে দলের দুঃশ্চিন্তা দূরীকরণে অগ্রসর হতেন। প্রত্যেকবারই ক্রিজে অবস্থান করে সমৃদ্ধ ইতিহাস রচনায় দুঃখকে দূর করতেন। তাঁর এ খেলার ধারায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ইংল্যান্ড দল। নিজের স্বর্ণালী সময়ে থাকাকালীন ডগলাস জারডিন বডিলাইন সিরিজে ঘৃণিত কৌশল অবলম্বন করলে তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দেন। ঐ কুখ্যাত সিরিজে মাত্র ৫৬.৫৭ গড়ে রান পেয়েছিলেন। সমগ্র অস্ট্রেলিয়া দল শরীর বরাবর বোলিংয়ের মোকাবেলায় হিমশিম খায়। তাসত্ত্বেও, ইনিংসপ্রতি ৫০ ঊর্ধ্ব রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের ঐ অ্যাশেজ সিরিজে কেবলমাত্র একবারই দলের পরাজয়ের সাথে জড়িত থাকেন। ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ৩০৪ রান তুলেছিলেন।

১৯৩৪ সালে অ্যাডিলেডে চলে যান। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের বড় ধরনের ক্রীড়া কৌশল অবলম্বনে অগ্রসর হয়েছিলেন। ক্রিকেটের বাইরে থেকে পেশাদারী পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে অ্যাডিলেড স্টক এক্সচেঞ্জের সাথে যুক্ত ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, হেনরি হজেটস নামীয় স্টকব্রোকার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানির পরিচালক ছিলেন। অবশ্য সেখানে বিতর্কের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন ও ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৩৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দল নির্বাচক ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে সাউথ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন ও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডে যুক্ত ছিলেন। তন্মধ্যে, সাউথ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ ও ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৩৮ সালে লর্ডসে নিজস্ব দ্বিতীয় ও সর্বশেষ শতক হাঁকান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র হওয়া ঐ টেস্টে ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন। এ টেস্টের প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৮ রান তুলতে পেরেছিলেন। চূড়ান্ত দিনে ৩১৫ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে ধাবমান অবস্থায় বেশ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীমায় দর্শনীয় খেলা উপহার দেয়াকালে এক পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের সম্ভাবনা চলে এসেছিল। অধিনায়ক হিসেবে তিনি তাঁর সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৩৬ বল নিয়ে গড়া ঐ ইনিংসে ১৫টি চারের মার মেরেছিলেন। শতরানের কল্যাণে আরও একবার লর্ডস অনার্স বোর্ডে নিজেকে ঠাঁই করে নেন।

৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়ে রান সংগ্রহের বিষয়টি তাঁর ক্রিকেট খেলোয়াড়ী জীবনে অসাধারণ উপমা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। টেস্টের ৮০ ইনিংসে ৬৯৯৬ রান সংগ্রহ করেন। ২৯টি টেস্ট শতক হাঁকান ও তৎকালীন বিশ্বরেকর্ডরূপে চিত্রিত হয়। এছাড়াও, ১৩টি অর্ধ-শতকসহ যে-কোন ব্যাটসম্যানের তুলনায় সবচেয়ে বেশী ১২টি দ্বি-শতক ইনিংস খেলেন। অর্ধ-শতক ও শতকের অনুপাত ছিল ১ : ২.২৩। প্রতি দুই টেস্টে একটি শতরান করেছেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯টি শতক হাঁকিয়েছিলেন।

ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বাধিক রেকর্ডসংখ্যক ৯৬১ পয়েন্ট নিয়ে অতি উচ্চ মানসম্পন্ন টেস্ট ব্যাটসম্যানরূপে স্বীকৃতি পেয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে কোন একটি সিরিজে যে-কোন ব্যাটসম্যানের তুলনায় সর্বাধিক ৯৭৪ রান সংগ্রহের কৃতিত্বের অধিকারী। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দুইবার ত্রি-শতরানের ইনিংস হাঁকান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেকের ন্যায় মূল্যবান স্বর্ণালী আট বছর নষ্ট হয়ে যায়। নয়তোবা তাঁর পরিসংখ্যান আরও অধিক সমৃদ্ধতর হতে পারতো। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৫ টেস্টে অংশ নিয়ে আট শতক সহযোগে ১০৫-এর অধিক গড়ে রান পেয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে ক্রিকেট খেলা শুরু হলে দূর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে খেলেন। এ পর্যায়ে অজি দলকে ১৫ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১১টিতে জয় এনে দেন। ১৯৪৮ সালে সর্বশেষ ইংল্যান্ড সফরে যান। দলকে নেতৃত্ব দিয়ে অন্যান্য খেলোয়াড়ের সাথে স্মরণীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কোন খেলায় দল পরাজয়ের সন্ধান পায়নি ও অ্যাশেজ সিরিজে ৪-০ ব্যবধানে বিজয়ী হয়। ফলশ্রুতিতে, ‘অপরাজেয়’ উপাধিতে ভূষিত হয় অস্ট্রেলিয়া দল।

১ জানুয়ারি, ১৯৪৮ তারিখে লন্ডনের ওভালে অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়। শেষবারের মতো ব্যাট হাতে নিয়ে ১০০ গড়ের অধিকারী হবার জন্যে তাঁর প্রয়োজন ছিল মাত্র চার রান। তবে, দুইবার বল মোকাবেলা করে শূন্য রানে বিদেয় নিতে হয়। এরিক হোলিসের ফুল টসে কুপোকাত হন। এ ঘটনায় ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদসহ সাধারণ জনগণ ঐ মুহূর্তকে ‘ঈশ্বরের কলঙ্করূপে’ আখ্যায়িত করে। ৯৯.৯৪ গড়ে খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করার ফলে এবিসি’র পোস্ট বক্স নম্বর ৯৯৯৪ রাখা হয়। তাসত্ত্বেও, স্বাগতিকরা ইনিংস ও ১৪৯ রানে পরাজয়বরণ করে।

‘হি’জ আউট!’–লন্ডনের সান্ধ্যকালীন সংবাদপত্রে দুই শব্দের শিরোনামটি ক্রিকেটের সাথে জড়িত না হলেও পাঠকদের দৃষ্টিগোচরীভূত হয়। একটিই অর্থ দাঁড়ায়–তাহলো, কোথাও, কেউ না কেউ ডন ব্র্যাডম্যানকে আজীবন সম্মাননা থেকে বঞ্চিত করেছেন। চূড়ান্ত ইনিংসে শূন্য রানে বিদেয় নেয়ায় ০.০৬ গড়ে দৃশ্যতঃ নষ্ট হয়ে পড়লে সামগ্রীক চিত্রটির আবেদন নষ্ট হয়ে পড়ে। সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে সাতটি শূন্য রানের সন্ধান পেলেও ভ্রুক্রুটিসহ তারকা খ্যাতিতে বৃহৎ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও, ৩৬.০০ গড়ে দুই উইকেট দখল করেছেন। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৯৫.১৪ গড়ে ২৮০৬৭ রান তুলেছেন।

১৯৪৯ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। একই বছরে একমাত্র অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার হিসেবে নাইট পদবীতে ভূষিত হন। ১৬ জুন, ১৯৭৯ তারিখে ‘ক্রিকেট ও ক্রিকেট প্রশাসনে অসামান্য ভূমিকা গ্রহণের’ স্বীকৃতিস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কম্পানিয়ন অব দি অর্ডার অব অস্ট্রলিয়া (এসি) পদবী প্রদান করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্পোর্ট অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত প্রথম দশজনের অন্যতম ছিলেন। ২৭ আগস্ট, ২০০৮ তারিখে তাঁর জন্মদিনকে ঘিরে রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান মিন্ট কর্তৃপক্ষ ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের প্রতিকৃতিসহ $৫ ডলারের স্মারকসূচক স্বর্ণমুদ্রা প্রকাশ করে।

১৯৩১ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটার ও ২০০০ সালে শতাব্দীর সেরা ক্রিকেটার হিসেবে সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। ২০০৯ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাউরেলে ব্র্যাডম্যান মিউজিয়ামের বাইরে তাঁর প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়।

ক্রিকেট ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক হিসেবে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেন। অংশ নেয়া বিভিন্ন ক্রিকেট মাঠসহ শিল্পকর্মের অন্যতম বিষয়ে পরিণত হন। বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। তন্মধ্যে, ১৯৫০ সালে ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’, ১৯৫৮ সালে ‘দি আর্ট অব ক্রিকেট’ প্রকাশ করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। ১৯৩২ সালে জেসি মার্থা মেনজিসের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যকার বৈবাহিক সম্পর্ক ১৯৯৭ সালে জেসি মেনজিসের মৃত্যুবরণের পূর্ব-পর্যন্ত অটুঁট ছিল। সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার কেনসিংটন পার্ক এলাকায় ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০১ তারিখে ৯২ বছর ১৮২ দিন বয়সে মহান খেলোয়াড়ের দেহাবসান ঘটে। দৈহিকভাবে বিশ্বে তাঁর অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও সন্দেহাতীতভাবেই ক্রিকেট বিশ্বে অমরত্ব লাভ করেছেন। ডব্লিউ.জি’র ন্যায় তাঁর খ্যাতি কখনো মলিন হবার নয়।

২৫ মার্চ, ২০০১ তারিখে তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। সরাসরি সম্প্রচারিত ঐ অনুষ্ঠানটি ১.৪৫ মিলিয়ন দর্শক উপভোগ করে। সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটারসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রী বব হক, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জন হওয়ার্ড ও বিরোধীদলীয় নেতা কিম বিজলি এতে অংশ নেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।