ক্রিস গেইল
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯ তারিখে জ্যামাইকার কিংস্টনে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার। মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে খেলেছেন। বামহাতে ব্যাটিং কর্মে অগ্রসর হয়েছিলেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিং কর্মে পারদর্শী। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিকে অংশ নিয়েছেন ও দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
৬ ফুট ২ ইঞ্চি (১.৮৮ মিটার) উচ্চতার অধিকারী। ডাডলি গেইল ও হাজেল গেইল দম্পতির সন্তান। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুম থেকে ২০১৪-১৫ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে জ্যামাইকা, দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটে ডলফিন্স ও লায়ন্স, জিম্বাবুয়ীয় ক্রিকেটে মাতাবেলেল্যান্ড তুস্কার্স, ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে সমারসেট ও ওরচেস্টারশায়ার এবং অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, বাল্খ লিজেন্ডস, বরিশাল বার্নার্স, রংপুর রাইডার্স, চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স, চিটাগং ভাইকিংস, ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স, আইসিসি বিশ্ব একাদশ, জ্যামাইকা তল্লাজ, সেন্ট কিটস ও নেভিস প্যাট্রিয়টস, স্ট্যানফোর্ড সুপারস্টার্স, জোজি স্টার্স, ক্যান্ডি তুস্কার্স, করাচী কিংস, কোয়েটা গ্ল্যাডিয়েটর্স, লাহোর কালান্দার্স, কিংস ইলাভেন পাঞ্জাব, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা নাইট রাইডার্স, মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব, সিডনি থান্ডার, মেলবোর্ন রেনেগাডেস ও ভ্যাঙ্কুভার নাইটসের পক্ষে খেলেছেন।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০১ তারিখে চতুর্শতক জুটি দাঁড় করান। বুস্টা কাপে জ্যামাইকার সদস্যরূপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ‘বি’ দলের মোকাবেলা করেন। প্রথম উইকেটে লিওন গারিকের সাথে ৪২৫ রানের নিরবিচ্ছিন্ন জুটি গড়েন। এরফলে, ঐ অঞ্চলের ইতিহাসের প্রথম চারশতাধিক রানের জুটি গড়ে রেকর্ড গড়েন।
বিধ্বংসী উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন। অল-রাউন্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে উইকেট লাভেও তৎপরতা দেখিয়ে আসছেন। আক্রমণাত্মক ধাঁচের ক্রীড়াশৈলী অনেকাংশেই সীমিত-ওভারের উপযোগী। তাসত্ত্বেও দীর্ঘ সংস্করণের খেলায়ও সফলতা দেখিয়েছেন। বেপরোয়া ভূমিকার কারণে ‘ইউনিভার্স বস’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে উভয় স্থানেই তাঁর চেয়ে অন্য কাউকে বিনোদন দিতে দেখা যায়নি।
১৯৯৯ থেকে ২০২১ সময়কালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বমোট ১০৩ টেস্ট, ৩০১টি ওডিআই ও ৬১টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছেন। তন্মধ্যে, ১৯৯৯ সালে একদিনের আন্তর্জাতিকে অংশ নিয়েছেন। দলের সাথে ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে ত্রি-দেশীয় সিরিজ খেলতে কানাডা গমন করেন। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯ তারিখে টরন্টোয় অনুষ্ঠিত ভারতের বিপক্ষে ওডিআইয়ে অংশ নেয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনের সূত্রপাত ঘটান। তবে, অভিষেক পর্বটি মোটেই সুবিধের হয়নি। মাঝারিসারিতে ব্যাটিংয়ে নামেন। পাঁচ ইনিংস থেকে কেবলমাত্র একবার দুই অঙ্কের কোটা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত ওডিআইয়ে ১৩২ রানের অপরাজিত ইনিংস উপহার দিয়ে তীব্র উত্তেজনাকর খেলায় দলকে জয়লাভে সহায়তা করেন। এরপূর্বে খেলা থেকে তিন উইকেট লাভ করলে স্বাগতিক দল অ্যান্ড্রু স্ট্রস ও অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের শতরানের কল্যাণে নির্ধারিত ৫০-ওভারে ২৮৫/৭ তুলতে সমর্থ হয়। এর জবাবে ৯৯ রান থাকাকালীন প্রায় রান-আউটের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। পাঁচ বল বাকী থাকতে দলকে জয় এনে দেন। এ ইনিংসটি ১২টি চার ও একটি ছক্কার মারে ২১২ মিনিটে ১৬৫ বল মোকাবেলান্তে গড়ে উঠে। ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন। পাশাপাশি, শতক হাঁকানোর স্বীকৃতিস্বরূপ লর্ডসের সীমিত-ওভারের অনার্স বোর্ডে তাঁর নাম লিপিবদ্ধ হয়।
১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে নিজ দেশে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের নেতৃত্বাধীন জিম্বাবুয়ীয় দলের মুখোমুখি হন। ১৬ মার্চ, ২০০০ তারিখে পোর্ট অব স্পেনে অনুষ্ঠিত সফররত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ওয়াভেল হাইন্ডসের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় তিনি ৩৩ ও ০ রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ৩/২৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তবে, কার্টলি অ্যামব্রোসের অসাধারণ বোলিংশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৩৫ রানে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
ওডিআই অভিষেকের ন্যায় এ স্তরের শুরুটাও মোটেই ভালো হয়নি। ৪২.১৮ গড়ে টেস্টে রান সংগ্রহ করেছেন। মার্চ, ২০০০ সালের পর থেকে নিজ নামের পার্শ্বে দুইটি ত্রি-শতক রান যুক্ত করার কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। সব মিলিয়ে টেস্টে ১৫টি শতক হাঁকান। তন্মধ্যে, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ করেছেন ৩৩৩ রান। একমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে টি২০আইয়ে শতক, ওডিআইয়ে দ্বি-শতক ও টেস্ট ক্রিকেটে ত্রি-শতকের সন্ধান পেয়েছেন।
২০০২ সালে নিজ দেশে স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ২৮ জুন, ২০০২ তারিখে গ্রেনেডার সেন্ট জর্জেসে অনুষ্ঠিত সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন ও ব্যক্তিগত সাফল্যের সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ১৭৫ রান অতিক্রম করেন। খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ২০৪ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ০/৫ ও ০/৭ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর অসাধারণ দ্বি-শতকের কল্যাণে ঐ টেস্টটি ড্রয়ে পরিণত হলেও স্বাগতিকরা ১-০ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৫-০৬ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেট খেলেন। এ মৌসুমে শিবনারায়ণ চন্দরপলের নেতৃত্বাধীন ক্যারিবীয় দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ৯ মার্চ, ২০০৬ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ২৫ ও ৮২ রান তুলেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ২/১০ ও ৪/৭১ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। শেন বন্ডের অসাধারণ বোলিংশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ২৭ রানে পরাজিত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
২০১০-১১ মৌসুমে ড্যারেন স্যামি’র নেতৃত্বাধীন ক্যারিবীয় দলের সদস্যরূপে শ্রীলঙ্কা গমন করেন। ১৫ নভেম্বর, ২০১০ তারিখে গলেতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। অপূর্ব ক্রীড়াশৈলীর স্বাক্ষর রাখেন। দলের একমাত্র ইনিংসে ত্রি-শতক হাঁকান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ফলাফলবিহীন অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
২০১২ সালে নিজ দেশে রস টেলরের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ২৫ জুন, ২০১২ তারিখে নর্থ সাউন্ডে অনুষ্ঠিত সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে নিজেকে জড়ান। প্রথম ইনিংসে ১২৭ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৬৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। ১৫০ ও ৬৪* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেন। সুনীল নারাইনের অসাধারণ বোলিংশৈলীর কল্যাণে সফরকারীরা ৯ উইকেটে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
২০১৪ সালে নিজ দেশে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ৮ জুন, ২০১৪ তারিখে কিংস্টনে অনুষ্ঠিত সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সন্ধান পান। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ রানে পৌঁছানোকালে ৭০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ৬৪ ও ১০ রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, ০/১৭ লাভ করেন। তবে, অভিষেকধারী মার্ক ক্রেগের অনবদ্য বোলিং নৈপুণ্যে সফরকারীরা ১৮৬ রানে জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। এরফলে, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে নিউজিল্যান্ড দল দ্বিতীয়বারের মতো জয়লাভে সমর্থ হয়।
২০১৪ সালে নিজ দেশে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশী দলের মুখোমুখি হন। ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ তারিখে কিংসটাউনে অনুষ্ঠিত সফররত বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্ট খেলেন। খেলায় তিনি ৬৪ ও ৯* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ১/৫০ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। ক্রেগ ব্রাদওয়েটের মনোরম দ্বি-শতকের কল্যাণে স্বাগতিকরা ১০ উইকেটে জয় পেলে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
টি২০ ক্রিকেট দৃশ্যতঃ ক্রিস গেইলকে শুভেচ্ছা দূতে পরিণত করেছে। এ ধরনের ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রায় সকল রেকর্ডই নিজের করায়ত্ত্ব করে রেখেছেন। তন্মধ্যে, সর্বাধিক দশ সহস্রাধিক রান সংগ্রহ, সর্বাধিক শতক হাঁকানো, দ্রুততম শতরানের সন্ধান পাওয়া এবং সর্বাধিক চার ও ছক্কা মেরেছেন।
আরসিবি’র পক্ষে ব্যাঙ্গালোরের সমর্থকদের মন জয়ের পর ২০১৮ সালে পাঞ্জাব কিংসে চলে যান। তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে আরও একটি দারুণ মৌসুম অতিবাহিত করেন। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে শতক হাঁকান। লোকেশ রাহুলের সাথে এ প্রতিযোগিতায় অন্যতম শক্ত জুটি দাঁড় করান। বোলিংকারী দলগুলোকে বামহাতি-ডানহাতির ব্যাট সামলাতে প্রায়শঃই যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।
২০১৯ সালেও দারুণ খেলেন। আইপিএলে সপ্তম শতকের দিকে ধাবমান হলেও ৯৯ রানে অপরাজিত থাকেন। চারটি অর্ধ-শতকের সন্ধান পান। সব মিলিয়ে ৩১৯ বল মোকাবেলান্তে ৪৯০ রান তুলেন। এ বামহাতি ব্যাটসম্যান ২০২০ সালেও একই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন। আরও একবার ৯৯ রানে বিদেয় নেন। তাসত্ত্বেও, ৭ খেলা থেকে প্রায় তিনশত রানের কাছাকাছি সংগ্রহ করেছেন। এ পর্যায়ে তিনি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলেন।
২০১০ সালে বর্ষসেরা জ্যামাইকান ক্রীড়াবিদ হিসেবে মনোনীত হন। জ্যামাইকার ‘অর্ডার অব ডিস্টিংক্টশন’ লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত তিনি। ৩১ মে, ২০০৯ তারিখে দীর্ঘদিনের মেয়েবান্ধবী নাতাশা বেরিজের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির ব্লাশ নাম্নী কন্যা রয়েছে।