|

ভাগবত চন্দ্রশেখর

১৭ মে, ১৯৪৫ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কর্ণাটকের মহীশূরে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার। মূলতঃ বোলার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। লেগ-ব্রেক বোলিং করতেন। এছাড়াও, নিচেরসারিতে ডানহাতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।

পাঁচ বছর বয়সে ডানহাতে পোলিওতে আক্রান্ত হন। তিন মাস তাঁকে হাসপাতালে অবস্থান করতে হয়। এ পঙ্গুত্বের ফলে তাঁর বাহু অতি নমনীয় পর্যায়ে চলে আসে ও বলে অতিরিক্ত প্রাণসঞ্চারণ ঘটায়। পরবর্তীকালে ভারতের বড় ধরনের খেলাগুলোয় জয়লাভে নিজেকে যুক্ত করতে সক্ষম হন। কব্জির শক্তি অঁটুট থাকে। ডানহাতে পোলিং আক্রান্ত হবার কারণে অস্বাভাবিকভাবে রিস্ট স্পিন বোলিং করতেন। এরফলে, কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দৌঁড়ে মিডিয়াম-পেস বোলিংয়ের কাছাকাছি লেগ-ব্রেকের পাশাপাশি গুগলি ও টপ স্পিনে গতিশক্তির সঞ্চার হয়।

১৯৬৩-৬৪ মৌসুম থেকে ১৯৭৯-৮০ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে কর্ণাটক ও মহীশূরের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বড় ধরনের স্পিনার ছিলেন না। তবে, কিছুটা দীর্ঘ দূরত্বে থেকে দৌঁড়ে নিখুঁততার সাথে বল ফেলার মাঝেই তাঁর শক্তি লুক্কায়িত ছিল। ব্যাটসম্যানেরা প্রায় মিডিয়াম পেস বোলিংয়ের ন্যায় তীক্ষ্ণ গুগলি, লেগ-ব্রেক ও মাঝারিমানের গতিতে টপ স্পিনে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হতো। স্পিনার চতুষ্টয়ের মাঝে তিনি অন্যতম হিসেবে বল ফেলে সমীহের পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন।

১০ বছর বয়সে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন ও শৈশবকালে বিখ্যাত অজি লেগ-স্পিনার রিচি বেনোকে পছন্দের তালিকার শীর্ষে রাখেন। ১৯৬৩-৬৪ মৌসুম থেকে ১৯৭৯-৮০ মৌসুম পর্যন্ত প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নেন। ১৯৭৫-৭৬ মৌসুম থেকে দুই বছরের জন্যে লিস্ট-এ খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। ব্যাঙ্গালোরে অবস্থানের ফলে সিটি ক্রিকেটার্সের পক্ষে খেলার সুযোগ পান। চামড়ার বল নিয়ে খেলাকালীন বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। ক্লাবে খেলতে শুরু করলে তিনি বোলিংয়ের ধরন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। এরপরই কেবল লেগ-স্পিনারের মর্যাদা পান।

১৬ বছরব্যাপী দীর্ঘ আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ী জীবনে বিষেন সিং বেদী, ইরাপল্লী প্রসন্ন ও শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবনের সাথে স্পিনার চতুষ্টয়রূপে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। দৃশ্যতঃ ১৯৬০-এর দশকের শেষদিক থেকে ১৯৭০-এর দশকের শুরুরদিক পর্যন্ত ভারতের কোন পেস বোলারের অস্তিত্ব ছিল না। এক পর্যায়ে তাঁদের সাথে সুনীল গাভাস্কারকে বল হাতে নিতে হয়েছিল। তবে, স্পিনার চতুষ্টয়ের মধ্যে তিনিই অধিক অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। সময়ে সময়ে অবশ্য বলকে নিখুঁত নিশানা বরাবর ফেলতে ব্যর্থ হলেও যখন তিনি ছন্দ ফিরে পেতেন তখন ব্যাটসম্যানদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হতেন।

১৯৬৪ থেকে ১৯৭৯ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ৫৮ টেস্ট ও একটিমাত্র ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড গমনার্থে ভারত দলের সদস্যরূপে মনোনীত হন। ১৭ বছর বয়সে তাঁর প্রতিভা সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয়। মহীশূর দলের সদস্য ছিলেন। তিন মাস পরই টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। টপ স্পিন ও গুগলিতে অনেক ভালোমানের ব্যাটসম্যানকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ক্রিজে আটকিয়ে রাখেন। এ পর্যায়ে তিনি রঞ্জী ট্রফিতে মাত্র চারটি খেলায় অংশ নিয়ে ২৫ উইকেট দখল করেছিলেন।

১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে নিজ দেশে সফররত এমসিসি দলের বিপক্ষে খেলার জন্যে বোর্ড সভাপতি একাদশে যুক্ত করা হয় তাঁকে। অবশ্য, খেলায় তিনি মাত্র এক উইকেটের সন্ধান পেয়েছিলেন। ফিল শার্পকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে বিদেয় করেন। এরজন্যে তাঁক ৫৪ রান খরচ করতে হয়েছিল। মাদ্রাজে মাইক স্মিথের নেতৃত্বাধীন সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেয়ার সুযোগ পাননি।

২১ জানুয়ারি, ১৯৬৪ তারিখে বোম্বের বিএসে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। রাজিন্দার পালের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। শূন্য রানে বিদেয় নেন। প্রথম ইনিংসে ৪০ ওভার বোলিং করে ৪/৬৭ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ১/৪০ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ০-০ ব্যবধানে এগুতে থাকে। ঐ সিরিজে অবশ্য তেমন সফল হননি। বিশেষতঃ স্পিনারদের বিপক্ষে দারুণ পরিচিতি পাওয়া কলিন কাউড্রে তাঁকে নিরাশ করেছিলেন। পরের বছর বয়সের তুলনায় নিজেকে আরও এগিয়ে রাখেন।

প্রথম কয়েক বছর মূলতঃ এলেমোলো ফিল্ডিংয়ের কারণে বিশেষতঃ উইকেটের কাছাকাছি ফিল্ডিংয়ের কারণে তেমন সফলতা পাননি। সফররত অস্ট্রেলিয়া দলকে টপ স্পিন প্রয়োগ বিভ্রান্তিতে ফেলেন।

১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে বব সিম্পসনের নেতৃত্বাধীন সফরকারী অজি দলের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো ভারতের বিজয়ে ভূমিকা রাখেন। ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের চতুর্থ টেস্টের উভয় ইনিংসে ৪ উইকেট পেয়েছিলেন। প্রথম দিনের সকালে বব সিম্পসনকে স্ট্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে বিদেয় করেন। ২৫৪ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় আট উইকেট খুঁইয়ে ফেলে ভারত দল। সাজঘর থেকে স্নায়ুচাপে প্যাড পড়েন।

১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড গমন করেন। এ সফরে ৫৭ উইকেট দখল করেন। তন্মধ্যে, স্লিপ অঞ্চল থেকে ক্রমাগত ক্যাচ ফসকে গেলেও টেস্টগুলো থেকে পেয়েছিলেন ১৬ উইকেট। তবে, পরের মৌসুমে পায়ের আঘাতে স্বাভাবিক খেলা থেকে বিরত থাকতে হয়। আরোগ্যলাভের এক পর্যায়ে পুণরায় স্কুটার দূর্ঘটনার কবলে পড়েন। এরফলে, ঘরোয়া আসরসহ বিদেশ সফরে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালে আবারও ফিরে আসেন। একনাথ সোলকারের নেতৃত্বে শর্ট-লেগ অঞ্চলে একদল দক্ষ ফিল্ডারের সমাগম ঘটে। অজিত ওয়াড়েকর তাঁদেরকে দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেন। এরপর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে সিডনিতে সর্বশেষ বিজয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। এ পর্যায়ে অবসর গ্রহণ থেকে ফিরে এসে বিশ্ব সিরিজ ক্রিকেটে অংশ নেয়ার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসেন। প্রথম ইনিংসে বব সিম্পসনের উইকেটসহ চার উইকেট পান। দ্বিতীয় ইনিংসে আরও দুই উইকেট লাভ করেন। এ পর্যায়ে ইরাপল্লী প্রসন্ন, বিষেন সিং বেদী ও কর্ষণ গাব্রি’র সহায়তা নিয়ে ভারত দল জয়ী হয়। মেলবোর্নে পূর্বেকার খেলায় উভয় ইনিংসে ৬ উইকেট লাভ করে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনে বেশ কয়েকবার আঘাতের কবলে পড়েন। এছাড়াও, রহস্যজনক দূর্ঘটনার কারণে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মাঠের বাইরে ছিলেন। সাড়ে তিন বছরে তিনি ১৯ টেস্ট খেলা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে খেলার গতিধারা পরিবর্তন করে ফেলেন। দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম ওভারে ব্রায়ান লাকহার্স্টের ক্যাচ নিলে হয়তোবা সাত উইকেট পেতেন ও তাঁর বল থেকে জন জেমসন রান-আউটের শিকার হন। প্রথম ইনিংসে স্বাগতিক দল ৭১ রানে এগিয়ে থাকা অবস্থায় মধ্যাহ্নভোজনের পূর্বে দুই বলে জন এডরিচকে মাঝের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলে বিদেয় করেন ও কিথ ফ্লেচারের ব্যাটের কিনারা স্পর্শ করে শর্ট-লেগ অঞ্চলে দণ্ডায়মান একনাথ সোলকার তালুবন্দী করেন। ভারতের বিপক্ষে ইংল্যান্ড দল সর্বনিম্ন রান তুললে ১৭৩ রানে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয় ও সিরিজ জয় করে।

১৯৭১ সালে ওভালে জন এডরিচকে দ্রুততার সাথে বল ফেলে বিদেয় করে সুখ্যাতি লাভ করেন। বল স্ট্যাম্পে আঘাতের পূর্বে তখনও তাঁর ব্যাট শূন্যে ছিল। অপর প্রান্ত রে ইলিংওয়ার্থ প্রকৃত বাউন্সারসমৃদ্ধ বলটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।

উইজডেনে মন্তব্য করা হয় যে, ‘বোম্বের রাস্তায় নৃত্য’ হতে থাকে। ১৯৭১ সালে ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬/৩৮ বোলিং পরিসংখ্যান গড়ে ভারতের জয়ে বড় ধরনের ভূমিকা রাখেন ও উইজডেন কর্তৃক ভারতের পক্ষে শতাব্দীর সেরা বোলিং অবদানকারীর পুরস্কার পান। ঐ খেলায় ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারত দল প্রথমবারের মতো টেস্টে জয়ের সন্ধান পায় ও তারকা বনে যান। প্রথম ইনিংসে ২/৭৬ পেয়েছিলেন।

পোর্ট অব স্পেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৪০৬ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভারতের বিজয় লাভের খেলায়ও তিনি আট উইকেট দখল করেছিলেন।

ঐ বছর ধারাবাহিকভাবে ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। ফলশ্রুতিতে, ১৯৭২ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননায় ভূষিত হন। পঞ্চম ভারতীয় হিসেবে এ সম্মাননার অধিকারী হন। ১৯৭২-৭৩ মৌসুমে নিজ দেশে টনি লুইসের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭২ তারিখে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ৫/৬৫ ও ৪/৪২ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ব্যাট হাতে নিয়ে ১* ও ১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। স্বাগতিকরা ২৮ রানে জয় পেয়ে পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে সমতায় চলে আসে।

একই সফরের মাদ্রাজ টেস্টে ভারতের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। জানুয়ারির সকালে ইডেনে ইংল্যান্ড দল ১৯২ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রসর হলে বিষেন বেদী সফরকারীদেরকে চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় ১৭/৪-এ পরিণত করেন। পঞ্চম দিন সকাল টনি গ্রেগ, মাইক ডেনিসের সাথে ৯৭ রান যুক্ত করলে জয়ের কাছাকাছি চলে আসে। এ পর্যায়ে ‘চন্দ্র…চন্দ্র’ বলে স্টেডিয়ামে মুহুর্মুহু করতালিতে দর্শকেরা তাঁর বোলিংকে স্বাগতঃ জানাতে থাকে। অ্যালান নটকে মিড-উইকেটে সেলিম দুরানি তালুবন্দী করেন। গুগলিতে ডেনিসকে পরাস্ত করেন। এ সময়ে তাঁর বোলিং ছিল ৪.৩-২-৫-৩। অবশেষে মধ্যাহ্নভোজনের অল্প কিছু সময় পর বব কটামকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে প্রতিপক্ষকে ১৬৩ রানে গুটিয়ে দেন। কল্লোলিনী কলকাতা তখন আনন্দের জোয়াড়ে ভেসে যায়।

দুই বছর পর আরও একবার আনন্দঘন মুহূর্তের সাথে নিজেকে জড়ান। ইডেন গার্ডেন্সে ১৫০-এরও কম লক্ষ্যমাত্রায় সাত উইকেট হাতে নিয়ে খেলতে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। সকালে দর্শকেরা তখনও আসনে বসতে পারেননি। এ সময়ে ক্লাইভ লয়েডআলভিন কালীচরণ ব্যাট হাতে নামেন। পতৌদির নবাব মনসুর আলী খান তাঁকে বল দেন। ক্লাইভ লয়েডের প্যাড স্পর্শ করে স্ট্যাম্পে আঘাত হানে। আলভিন কালীচরণ তাঁর বলে স্লিপে প্রেরণ করলে গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের মুঠোয় চলে আসে। ভারত দল ৮৫ রানে জয়লাভ করলে উল্লাসে দর্শকেরা মেতে উঠে।

এক স্বাক্ষাৎকারে ডেনিস লিলি’র সাথে ভিভিয়ান রিচার্ডস তাঁকে অন্যতম দুর্বোধ্য বোলার হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন। ভিভ রিচার্ডস টেস্ট অভিষেকে প্রথমবারের মতো তাঁর লেগ-স্পিন মোকাবেলায় অগ্রসর হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের শীতকালে ব্যাঙ্গালোর টেস্টের উভয় ইনিংসেই তিনি ৪ ও ৩ রান তুলে তাঁর বলে বিদেয় নিয়েছিলেন। অজানা কারণে দ্বিতীয় টেস্ট থেকে বাদ পড়েন ও দল নির্বাচকমণ্ডলী তিনজন ফিঙ্গার-স্পিনারকে খেলায়। বিষেন সিং বেদীকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়। ঐ টেস্টে ভিভ রিচার্ডস ২০ চার ও ৭ ছক্কা সহযোগে ১৯২ রানের দূর্দান্ত ইনিংস খেলেন। অবশ্য সিরিজের শেষ তিন টেস্টে তাঁকে ভারত দলে যুক্ত করা হয়। অংশগ্রহণকৃত ঐ চার টেস্টে ভিভ রিচার্ডস মাত্র একটি অর্ধ-শতক সহযোগে ২৩ গড়ে ১৬১ রান তুলতে পেরেছিলেন। সবমিলিয়ে ঐ সিরিজে তাঁকে তিনবার বিদেয় করেছিলেন।

১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে সুনীল গাভাস্কারের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭৬ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ইরাপল্লী প্রসন্নের সাথে একত্রে ১৯ উইকেট নিয়ে স্বাগতিক দলের বিপক্ষে টেস্টে জয় এনে দেন। নিজে পেয়েছিলেন আট উইকেট। খেলায় তিনি ৬/৯৪ ও ২/৮৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, একবার ব্যাট হাতে নিয়ে বেভান কংডনের বলে শূন্য রানে বিদেয় নেন। সফরকারীরা ৮ উইকেটে জয়লাভ করলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।

একই সফরের ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজস্ব প্রথম ও একমাত্র ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ঐ খেলায় ৩/৩৭ বোলিং পরিসংখ্যান গড়ে দলের সকলের চেয়ে নিজেকে এগিয়ে রেখেছিলেন। তবে, ব্যাটিং ব্যর্থতায় ভারত দল পরাজয়ের সম্মুখীন হয়।

১৯৭৬ সালে বিষেন বেদী’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের অন্যতম সদস্যরূপে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরে যান। ৭ এপ্রিল, ১৯৭৬ তারিখে পোর্ট অব স্পেনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি বল হাতে নিয়ে ৬/১২০ ও ২/৮৮ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ব্যাট হাতে নিয়ে একবার ব্যাটিংয়ে নেমে শূন্য রানে অপরাজিত হওয়াসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। ঐ টেস্টে তাঁর দল ছয় উইকেটে জয়লাভ করলে চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে সমতায় নিয়ে আসে।

১৯৭৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়ে দারুণ ভূমিকা রাখেন। মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত ঐ টেস্টে ১০৪ রান খরচায় ১২ উইকেট দখল করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে শ্রীনিবাস বেঙ্কটরাঘবনের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের সদস্যরূপে আরও একবার ইংল্যান্ড সফরে যান। টনটনে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতিমূলক খেলায় সমারসেটের বিপক্ষে খেলে ভারতীয় একাদশ। উইকেট-রক্ষক সুরিন্দর খান্নাকে ভিভ রিচার্ডস বলেন যে ‘তাঁকে কেন দলে রেখেছ?’ দলের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ তাঁকে বোলিং আক্রমণে নিয়ে আসেন ও ‘এই নাও আমার উপহার’ বলে রিচার্ডসকে বিদেয় করেন।

১২ জুলাই, ১৯৭৯ তারিখে বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে সর্বশেষ খেলেন। প্রথম ইনিংসে ১১৩ রান খরচ করলেও কোন উইকেট লাভে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। এজবাস্টনে অনুষ্ঠিত ঐ টেস্টে জিওফ বয়কটের ১৫৫ ও ডেভিড গাওয়ারের ২০০* রানের সুবাদে ভারত দল ইনিংস ও ৮৩ রানের ব্যবধানে পরাজয়বরণ করেছিল। এছাড়াও, কোন রান না পেলেও উভয় ইনিংসেই অপরাজিত ছিলেন। এরপর, সিরিজের বাদ-বাকী টেস্টে তাঁকে খেলানো হয়নি ও আর তাঁকে ভারতের পক্ষে খেলতে দেখা যায়নি।

পাকিস্তানের তরুণ ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে তাঁর বোলিংয়ের ধার কমে যায়। ভারতীয় স্পিনারদের উপযোগী করে উইকেট প্রস্তুত করা হয়েছিল। ত্রয়ী-স্পিনারদের মধ্যে তিনি সেরা ছিলেন। ৪৮ গড়ে ৮ উইকেট পান। দৃশ্যতঃ তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন শেষের দিকে চলে যেতে থাকে। বোম্বেতে আলভিন কালীচরণের নেতৃত্বাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিপক্ষে পাঁচ-উইকেট পেলেও সফরকারীরা ৪৯৪ রান তুলে।

একটিমাত্র ওডিআইয়ে অংশ নিলেও অনেকগুলো টেস্টে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২৯.৭৪ গড়ে ও উইকেট প্রতি ৬৫.৯০ বল খরচ করে ২৪২ উইকেট দখল করেন। ১৯৭০-এর দশকে ভারতের অনেকগুলো জয়ে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সব মিলিয়ে ১৪ টেস্ট জয়ে ১৯.২৭ গড়ে ও বিস্ময়কর ৪৫.৪০ স্ট্রাইক রেটে ৯৮ উইকেট পান। এ পর্যায়ে ১৬-বার পাঁচ-উইকেট ও দুইবার দশ-উইকেট লাভ করেন। তন্মধ্যে, পাঁচবারই বিদেশের মাটিতে দলের জয়ে ভূমিকা রাখেন ও নিজেকে ভারতীয় ক্রিকেটে কিংবদন্তীতে পরিণত করেন। উইকেট লাভের তুলনায় সংগৃহীত রান কম থাকার ন্যায় অমর্যাদাকর রেকর্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। নিউজিল্যান্ডীয় ফাস্ট বোলার ক্রিস মার্টিনের পর দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ব্যাট হাতে ১৬৭ রানের তুলনায় ২৪২ উইকেট পেয়েছেন।

১৯৭০-এর দশকে ভারতের অনেকগুলো জয়ে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন। সন্দেহাতীতভাবে বিদেশের মাটিতে দীর্ঘদিন ভারতের বড় ধরনের খেলায় জয়লাভে ভূমিকা রেখেছিলেন। বিদেশে পাঁচবার টেস্ট জয়ে ৪২ উইকেট শিকার করেছিলেন।

২০০৪ সালে বিষেন সিং বেদী, ইএএস প্রসন্ন ও শ্রীনিবাস বেঙ্কটরাঘবনের সাথে একত্রে সিকে নায়ড়ু পুরস্কার গ্রহণ করেন।

সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনেই বল হাতে নিয়ে খেলার বাঁক ঘুরিয়ে দিতেন। তবে, ব্যাট হাতে পুরোপুরি উল্টো চিত্র ধরা পড়ে। অবসরগ্রহণকালীন তৎকালীন রেকর্ডসংখ্যক ২৪বার শূন্য রানের সন্ধান পান ও ৪.৬৭ গড়ে রান তুলেছেন। সব মিলিয়ে টেস্টে ১৬৭ রান সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। সংখ্যার দিক দিয়ে প্রাপ্ত উইকেটের চেয়েও ৭৫ রান কম ছিল। অভিষেকে প্রথম বলেই শূন্য রান সংগ্রহের অগৌরবজনক অধ্যায়ের সাথে যুক্ত থাকলেও দ্বিতীয় টেস্টে বাপু নদকর্নি সাথে ৫১ রানের জুটি দাঁড় করিয়েছিলেন। ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে অনুষ্ঠিত সিরিজে চারবার শূন্য রান সংগ্রহের কারণে গ্রে-নিকোলস ব্যাট তাঁকে উপহার দেয়া হয়। তন্মধ্যে, মেলবোর্ন টেস্টে কিং পেয়ার লাভ করেছিলেন।

অবসর গ্রহণের পর দূর্ঘটনা ও শারীরিকভাবে পঙ্গুত্বের দিকে নিজেকে নিয়ে যান। ১৯৯১ সালে অ্যাডিলেডে ক্লাব ক্রিকেট মৌসুম শেষে ব্যাঙ্গালোরের ফিরে আসার পর মেলবোর্নে পেশাদারী পর্যায়ে গ্রীষ্মে খেলার প্রস্তুতিকালে ট্রাক দূর্ঘটনার কবলে পড়েন। তিন মাস হাসপাতালে শয্যাশায়ী হন। এরপর থেকে ক্রাচে ভর করে হাটতে থাকেন। ২০১১ সালে পার্থে অস্ট্রেলিয়া-ভারতের মধ্যকার তৃতীয় টেস্টের প্রথম দিন উপস্থিত হন। ঐ দিনটি ভারতে পোলিওহীন প্রথম পূর্ণাঙ্গ বছর উদযাপন করা হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। সন্ধ্যা চন্দ্রশেখর নাম্নী এক রমণীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮ জানুয়ারি, ২০২১ তারিখে স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাঁকে হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।

Similar Posts

  • | | |

    বব উইলিস

    ৩০ মে, ১৯৪৯ তারিখে কো ডারহামের সান্ডারল্যান্ড এলাকায় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার ছিলেন। মূলতঃ বোলার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ফাস্ট বোলিংয়ের পাশাপাশি ডানহাতে নিচেরসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। ইংল্যান্ড দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। জন্মসনদে তাঁকে রবার্ট জর্জ উইলিস নামে পরিচিতি ঘটানো হয়েছেন। ‘গুস’, ‘ডাইল্যান’, ‘হ্যারল্ড’ কিংবা ‘সোর্ডফিশ’ ডাকনামে ভূষিত বব উইলিস ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি…

  • | | | |

    চান্দু বোর্দে

    ২১ জুলাই, ১৯৩৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রের পুনায় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার, প্রশাসক ও রেফারি। দলে মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে খেলতেন। মাঝারিসারির ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ভূমিকা রাখলেও কার্যকর লেগ-ব্রেক বোলিং করতেন। এছাড়াও, ভারত দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পুনাতে বসবাসরত মারাঠী খ্রিস্টান পরিবারে তাঁর জন্ম। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোন নিয়ে গড়া বিশাল পরিবারের সদস্য তিনি। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা…

  • | |

    বিনু মানকড়

    ১২ এপ্রিল, ১৯১৭ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জামনগর এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ অল-রাউন্ডার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ভারত দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডার ছিলেন। নিজের স্বর্ণালী সময়ে যে-কোন বিশ্ব একাদশে ঠাঁই পাবার অধিকারী ছিলেন। পেশাদারী পর্যায়ে…

  • |

    লেসলি উইট

    ২৮ মে, ১৯২৯ তারিখে ব্রিটিশ গায়ানার জর্জটাউনে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং কর্মে মনোনিবেশ ঘটাতেন। ১৯৫০-এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। বন্ধুদের কাছে ‘লেস’ নামে পরিচিত ছিলেন। ইনিংস উদ্বোধনে ধৈর্য্যশীল ও নিয়মানুবর্তীতার বিমূর্ত প্রতিমূর্তি ছিলেন। অসম্ভব মনোযোগের অধিকারী হিসেবে উইকেট থেকে খুব সহজে বিদেয় নিতে চাইতেন…

  • |

    দিলীপ দোশী

    ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ তারিখে গুজরাতের রাজকোটে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ বোলার হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। স্লো লেফট-আর্ম অর্থোডক্স বোলিং করতেন। এছাড়াও, বামহাতে নিচরসারিতে ব্যাটিংয়ে নামতেন। ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন। ১৯৬৮-৬৯ মৌসুম থেকে ১৯৮৬ সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে বাংলা ও সৌরাষ্ট্র এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে নটিংহ্যামশায়ার…

  • | |

    কেন উইলিয়ামসন

    ৮ আগস্ট, ১৯৯০ তারিখে তৌরাঙ্গা এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার। মূলতঃ শীর্ষসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করে থাকেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী। নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৭ সাল থেকে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর নিউজিল্যান্ডীয় ক্রিকেটে নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টস এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে…