রশীদ লতিফ
১৪ অক্টোবর, ১৯৬৮ তারিখে সিন্ধু প্রদেশের করাচীতে মুহাজির পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ও কোচ। মূলতঃ উইকেট-রক্ষক-ব্যাটসম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও, ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। পাশাপাশি, লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে দক্ষ ছিলেন। পাকিস্তান দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
উইকেট-রক্ষণ ও ডানহাতে ব্যাটিং করে উভয় বিভাগেই সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। ১৯৯২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে এক দশকের অধিক সময় পাকিস্তান ক্রিকেট দলে খেলেছেন। এ পর্যায়ে উইকেট-রক্ষণের অবস্থানে মঈন খানের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। তবে, টেস্ট ও ওডিআইয়ে তাঁর তুলনায় কম খেললেও ক্রিকেট বিশ্লেষকদের ধারনা যে, তিনি তাঁর চেয়ে উইকেট-রক্ষণে এগিয়েছিলেন। কিছু সময়ের জন্যে দলে সদা-সর্বদাই আসা-যাবার পালায় অবস্থান করতেন।
এনইডি ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকধারী হন। এখানে সাঈদ আনোয়ারের সাথে একত্রে অধ্যয়ন করেছিলেন। মালির কোম্পানিয়ন ক্লাবের পক্ষে খেলোয়াড়ী জীবনের সূত্রপাত ঘটান। এ সময়ে তাঁর নিজস্ব গ্লাভস ছিল না ও ক্লাব থেকে গ্লাভস সরবরাহ করা হতো। তবে, ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের পক্ষে খেলতে শুরু করলে সেলিম ইউসুফের কাছ থেকে গ্লাভস পেয়েছিলেন।
দলের ব্যাটিং বিভাগকে আরও শক্তিশালী করতে তাঁকে দলের সদস্য করা হয় ও টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। তবে, ক্রিকেটে সাফল্যের তুলনায় বিতর্কিত বিষয়ে যুক্ত থেকে নিজেকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে তৎপর হন। ওয়াসিম বারি’র পর তাঁকে সর্বাপেক্ষা দায়িত্বশীল উইকেট-রক্ষক হিসেবে বিবেচনায় আনা হতো। ১৯৮৬-৮৭ মৌসুম থেকে ২০০৪-০৫ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর পাকিস্তানী ক্রিকেটে অ্যালাইড ব্যাংক, করাচী ও ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে অ্যালাইড ব্যাংকের পক্ষে খেলতে শুরু করেন। এর পরপরই জাতীয় দল নির্বাচকমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষমতা দেখান।
১৯৯২ থেকে ২০০৩ সময়কালে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বমোট ৩৭ টেস্ট ও ১৬৬টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ড গমনার্থে জাভেদ মিয়াঁদাদের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের সদস্যরূপে মনোনীত হন। এ সফরেই স্বাগতিক ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে টেস্ট ও ওডিআইয়ে প্রথমবারের মতো অংশ নেন। ৬ আগস্ট, ১৯৯২ তারিখে সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। সুন্দর সূচনা করেন। কেনসিংটন ওভালে অনুষ্ঠিত টেস্টের প্রথম ইনিংসে নিখুঁত ৫০ রান তুলে চমৎকার খেলোয়াড় হিসেবে নিজের পরিচিতি ঘটান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। এছাড়াও, দুইটি ক্যাচ ও একটি স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়ান। তবে, ওয়াসিম আকরামের অসাধারণ বোলিংশৈলীতে সফরকারীরা খেলায় ১০ উইকেটে জয় পেলে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়।
কয়েক সপ্তাহ পর একদিনের আন্তর্জাতিকে অভিষেক ঘটে। ২০ আগস্ট, ১৯৯২ তারিখে নটিংহামে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় ২৯ রান তুলে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী হন। কিন্তু, ঐ খেলায় পাকিস্তান দল পরাজিত হয়। তবে, এরপর থেকে ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বেশ হিমশিম খেতে থাকেন।
১৯৯২-৯৩ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে জাভেদ মিয়াঁদাদের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ২ জানুয়ারি, ১৯৯৩ তারিখে হ্যামিল্টনে অনুষ্ঠিত সিরিজের একমাত্র টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ব্যাট হাতে নিয়ে ৩২* ও ৩৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে তিনটি ক্যাচ ও একটি স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখেন। ওয়াসিম আকরামের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৩৩ রানে পরাজিত হয়।
১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে পাকিস্তানের জিম্বাবুয়ে সফরের মাঝামাঝি পর্যায়ে নিজের অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। সেলিম মালিকের অধিনায়কত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় কিছু গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়লে ‘মি. ক্লিন’ ডাকনামে খ্যাত রশীদ লতিফ এ সিদ্ধান্ত নেন। বিচার কাইয়ুমের নেতৃত্বে তদন্তকালীন বাসিত আলীকে নিয়ে উপযুক্ত প্রমাণাদি দাখিল করেন। শুনানীতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে খেলায় পরাজয়ের প্রস্তাবনা পান। ১৯৯৮ সালে অধিনায়ক হিসেবে দলে ফিরে আসেন। এছাড়াও, ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুসের ন্যায় খেলোয়াড়েরাও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে খেলা গড়াপেটায় জড়িত বলে অভিযোগ করেন।
১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের পূর্ব-পর্যন্ত সবকিছুই ভালো চলছিল। কিন্তু, রমিজ রাজা ও আমির সোহেলের ন্যায় জ্যেষ্ঠ খেলোয়াড়েরা তেমন পরিবর্তন চাননি। এরপর, উপর্যুপরী দূর্বলমানের ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করলে পুণরায় দলের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হন। এ পর্যায়ে তিনি মাত্র তিনটি টেস্ট ও দুইটি ওডিআই সিরিজে দলকে পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওয়াসিম আকরামের পরিবর্তে অধিনায়ক হিসেবে খেলতে নেমে প্রথম টেস্টেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোড়া শূন্য রান লাভ করেন। এরফলে, অস্ট্রেলিয়ার মার্ক টেলরের পর ক্রিকেটের ইতিহাসের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে অগৌরবজনক রেকর্ডের অধিকারী হন। এরপর একটি ড্র ও একটি জয়ের সন্ধান পায় তাঁর দল। তবে, তিন বছর তাঁকে দলের বাইরে চলে যেতে হয়।
১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে পাকিস্তানী দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা গমন করেন। ৬ মার্চ, ১৯৯৮ তারিখে জিকিবার্হায় অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি উভয় ইনিংসে শূন্য রানে বিদেয় নিলেও উইকেটের পিছনে অবস্থান করে চারটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণের সাথে নিজেকে জড়ান। মার্ক বাউচারের অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ২৫৯ রানে জয় পেলে সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়।
২০০১ সালের ইংল্যান্ড সফরে বিস্ময়করভাবে দলে ফিরে আসেন। এ পর্যায়েও ছন্দহীনতার কবলে আচ্ছন্ন হন। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের বিপর্যয়কর ফলাফলের কারণে ওয়াকার ইউনুসের পরিবর্তে দ্বিতীয়বারের মতো অধিনায়কত্ব করেন। ওয়াসিম আকরাম, সাঈদ আনোয়ার ও ওয়াকার ইউনুস এ প্রতিযোগিতা শেষে অবসর গ্রহণ করেন এবং ইনজামাম-উল-হক, শোয়েব আখতার ও সাকলাইন মুশতাককে দলের বাইরে রাখা হলে তাঁকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। এ সময়ে দল বেশ ভালোভাবে অগ্রসর হতে থাকে। দলে স্থিরতা আনয়ণে সক্ষম হন ও ফলাফল অনুকূলে আসতে থাকে। তাসত্ত্বেও, এরপর আরও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। খেলায় নিষ্কলুষ ভাব ফিরিয়ে আনতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
২০০৩-০৪ মৌসুমে নিজ দেশে খালেদ মাহমুদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশী দলের মুখোমুখি হন। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৩ তারিখে মুলতানে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে দূর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনে অগ্রসর হন। সাতটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। এছাড়াও, উভয় ইনিংসে ৫ রান করে সংগ্রহ করেছিলেন। তবে, ইনজামাম-উল-হকের অতিদানবীয় শতকে নাটকীয়ভাবে এক উইকেটে জয় পায় তাঁর দল ও ৩-০ ব্যবধানে স্বাগতিকরা সিরিজ জয় করে নেয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
২০০৪ সালে পিসিবি থেকে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েন। ঘরোয়া আসরের ক্রিকেটে পিচ বিপজ্জ্বনক করার অভিযোগ আনা হয়। আইন অনুযায়ী খেলাটি পরিত্যক্ত করার কথা বলা হলেও করাচীর অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে দোষী করা হয় ও সঠিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। পরবর্তীতে অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা পাঁচ মাসে নিয়ে আসা হয়েছিল।
আইসিসি বরাবর খোলা চিঠিতে অভিনব পাতানো খেলার বিপদ নিয়ে সতর্ক করে দেন। পরবর্তীতে, বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করার ভুল দাবীর কারণে পাঁচ খেলা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হন। ২০০৪ সালে সিরিজের চূড়ান্ত টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে অলোক কাপালি’র ক্যাচ তালুবন্দী করার কথা দাবী করেছিলেন। এ সকল ঘটনায় পাকিস্তান বোর্ডের সাথে তাঁর তিক্ততাপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে ঐ সিরিজ শেষে ২০০৫ সালে তাঁকে অধিনায়কত্ব করা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ইনজামাম-উল-হককে অধিনায়ক ও কামরান আকমলকে উইকেট-রক্ষক হিসেবে স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
২০০৬ সালে ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরও বিতর্কিত বিষয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। অবসর গ্রহণ পরবর্তীকালে কোচিং জগতের দিকে ধাবিত হন। আফগানিস্তান দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। তবে, এ দায়িত্বে থাকাকালীন নগ্ন হস্তক্ষেপের বিষয় তুলে ধরে পদত্যাগ করেন। এরপর, ২০০৮ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড কর্তৃপক্ষে উইকেট-রক্ষণ কোচ হিসেবে তাঁকে মনোনীত করে। কিন্তু, এক মাস পরই বোর্ড পাতানো খেলাকে নজরে না রাখার বিষয়ে মন্তব্য করেন। ফলশ্রুতিতে, পাঁচ মাস পর পদত্যাগ করেন। তবে, দ্রুত এ পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এরপর, ২০১০ সালে আফগানিস্তান দলে ফিরে যান। এ পর্যায়ে প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
অবসর গ্রহণের পর অনুমোদনবিহীন ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লীগের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে, ২০০৯ সালে করাচীভিত্তিক রশীদ লতিফ ক্রিকেট একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০০ সাল থেকে পরিচালনা করা হলেও ২০০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। পাকিস্তান সুপার লীগের পরিচালনা পরিষদের অন্যতম সদস্য তিনি। পাশাপাশি, নিজ শহরের বিশেষ প্রাধিকারপ্রাপ্ত করাচী কিংসের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। বীরেন্দ্র শেহবাগের টুইটের জবাবে তিনি অপ্রীতিকর ভিডিও ছাড়েন। ভারতের সর্বত্র ঐ ভিডিওর সমালোচনা করা হয়। পরবর্তীতে, শেহবাগ এক টুইটে এ ধরনের অর্থবিহীন শব্দের চেয়ে নীরবতা থাকাই অধিক অর্থবোধকের কথা লিখেন। তবে, কয়েকদিন পরই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতকে পরাজিত করে শিরোপা ঘরে তুলেছিল। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা চলাকালীন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের কাছ থেকে বর্ণবাদের অভিযোগ আসে। পরবর্তীতে দলীয় ব্যবস্থাপনায় বিষয়টি উত্থাপিত করা হলে ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েডের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।