Skip to content

৩০ মে, ১৯০৯ তারিখে পানামার কোলনে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।

পানামার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম। ১৯১৯ সালে মাতা তাঁর জন্মস্থান জ্যামাইকায় তাঁকে প্রেরণ করেন। তাঁকে ইংরেজী ভাষী বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর হয়। সেখানেই ক্রিকেটে ও ফুটবলের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। ক্রিকেটকেই বেছে নেন তিনি। গৃহে নির্মিত ব্যাট ও বল নিয়ে কখনওবা নাওয়া-খাওয়া ভুলে খেলতেন। বিদ্যালয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তির উপযোগী ব্যাট ধরতে এক হাত হাতলে ও অপর হাত ব্লেডে রাখতেন। ক্রিকেটে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে পড়েন। সফররত আর্নেস্ট টিল্ডস্লে থেকে শুরু করে পার্সি হোমসের ন্যায় খেলোয়াড়দের খেলা দেখে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। তাসত্ত্বেও দন্ত বিষয়ের অধ্যয়নের জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমনের টিকিট প্রস্তুত ছিল তাঁর।

১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সময়কালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বমোট ২২ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। টেস্টের কোন সিরিজেই ব্যর্থতার পরিচয় দেননি। বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালে কেবলমাত্র ডন ব্র্যাডম্যান পরিসংখ্যানগতভাবে তাঁর তুলনায় এগিয়ে ছিলেন। খেলোয়াড়ী জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই প্রথম উইকেট পতনের পর মাঠে নামতেন। যদি কোন কারণে রান তুলতে ব্যর্থ হতেন কিংবা স্বল্প রানে বিদেয় নিতেন তাহলে তাঁর দল কোনক্রমে ১৫০ রান সংগ্রহ করতে পারতো।

১৯৩৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সাথে ইংল্যান্ড সফরে যান। লর্ডসে অসাধারণ খেলা উপহার দেন। তাসত্ত্বেও দলের পরাজয় রোধ করতে পারেননি। দলের সংগ্রহ ২৯/১ থাকা অবস্থায় তিন নম্বর অবস্থানে থেকে প্রথমবারের মতো ব্যাটিং করতে ক্রিজে নামেন। প্রথম ইনিংসে ১০৬ রান তুলেন ২৫০ মিনিট ব্যাটিং করে। ১৩টি চারের মার মেরে বিল কপসনের বলে বিদেয় নেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আরেকটি শতক হাঁকিয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পান। ১০৭ রানের মনোরম ইনিংস খেলে ইতিহাস গড়েন। ২৩০ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে আটটি চারের মারে ডগ রাইটের বলে স্যার লেন হাটনের তালুবন্দীতে পরিণত হন। এরফলে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে লর্ডস টেস্টের উভয় ইনিংসে শতরান করার কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন ও ইতিহাস গড়েন। তবে, তাঁর প্রাণান্তকর প্রয়াস চালানো সত্ত্বেও দলের পরাজয় অবলোকন করতে হয়। ক্রিকেটের স্বর্গভূমিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল স্বাগতিক ইংল্যান্ডের কাছে আট উইকেটে হার মানে।

নিজের খেলোয়াড়ী জীবনে ব্যাটসম্যান হিসেবে ডন ব্র্যাডম্যানের পর দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করেছিলেন। ক্রিকেট বিশ্লেষকদের অনেকেরই অভিমত যে, তিনি ঐ অবস্থানে থেকেই খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করেছিলেন। ‘কৃষ্ণাঙ্গ ব্র্যাডম্যান’ ডাকনামে পরিচিতি লাভ করেন। কেবলমাত্র দারুণ ক্রিকেটারই ছিলেন না তিনি, বরঞ্চ স্বীয় জনগোষ্ঠীর আশার প্রদীপ হিসেবে চিত্রিত হয়েছিলেন।

টেস্টগুলোয় ৬০.৮৩ গড়ে ২১৯০ রান পেয়েছেন। কমপক্ষে ২০ টেস্টে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের সর্বকালের তালিকায় ডন ব্র্যাডম্যান ও গ্রায়েম পোলকের পর তৃতীয় স্থানে অবস্থান করছেন। অপরদিকে অংশগ্রহণকৃত প্রথম-শ্রেণীর খেলাগুলো থেকে ৬৯.৮৬ গড়ে রান সংগ্রহ করেছেন। এরফলে কমপক্ষে ৫০ ইনিংসে অংশ নেয়া খেলোয়াড়েদের মধ্যে কেবলমাত্র ডন ব্র্যাডম্যান ও বিজয় মার্চেন্ট তাঁর তুলনায় এগিয়ে রয়েছেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে পানামার প্রত্যন্ত গ্রামে আট বছরের বালক জর্জ হ্যাডলি’র দূর্দান্ত ক্রীড়াশৈলীতে অভিভূত জনৈক দর্শক তাঁর দিকে এগিয়ে আসেন ও জিজ্ঞেস করেন যে, এরপূর্বে খেলেছে কি-না!

জবাবে তিনি বলেন যে, না।

তুমি কি রবিবারে বড় ধরনের খেলায় অংশ নিতে চাও?

জবাবে তিনি বলেন যে, এ বিষয়ের পিতা-মাতার সম্মতি নিতে হবে।

পিতা-মাতা দ্বিধায় পড়ে যান। তবে, পুণঃপুণঃ তাগাদায় তাঁরা এর মাঝে কোন অবৈধ কোন কিছুটা খুঁজে পাননি। তাঁরা সম্মতি প্রদান করেন।

ক্ষুদে জর্জ হ্যাডলি রোববারেও খেলতে থাকেন। নির্ধারিত স্থানে দণ্ডায়মান থেকে ক্যাচ মুঠোয় ধরার উদ্দেশ্যে ওৎ পেতে থাকেন। খেলার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দর্শনীয়তার সাথে বল তালুবন্দী করে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেন। সতীর্থ অন্যান্য খেলোয়াড়েরা তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে আনন্দে উল্লাসে মত্ত থাকে ও বাড়ী অবধি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসে। পিতা-মাতা তাজ্জব বনে যান।

তাঁর পিতা পানামা খাল নির্মাণে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। পিতা-মাতার ইচ্ছে ছিল দন্ত বিষয়ের তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনো করানোর। কয়েক বছর পর ১০ বছর বয়সে পানামার স্থানীয় স্প্যানীয় ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাঁকে জ্যামাইকায় পাঠানো হয়। নতুন জায়গায় ক্রিকেট খেলার সাথে যুক্ত হয়ে অবাক চোখে অবলোকন করেন ও এরপর থেকে খেলাটি আর তাঁর পিছু ছাড়েনি। ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নেয়া পূর্বের খাটো পোষাক পরিধান করতেন। ১৯২৭-২৮ মৌসুম থেকে ১৯৫৩-৫৪ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। সচরাচর তিন নম্বর অবস্থানে ব্যাট হাতে মাঠে নামতেন। এছাড়াও, চতুর্থ পরিবর্তিত বোলার হিসেবে লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে অগ্রসর হতেন।

১৯২৮ সালের শুরুতে স্থানীয় ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ প্রতিভাবান ক্রিকেটারের সন্ধান করছিল ও সম্মানীয় এলএইচ টেনিসনের নেতৃত্বাধীন দল ঐ দ্বীপে আসলে তাঁকে জ্যামাইকা দলের সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নর্দাম্পটনশায়ারের পেসার নবি ক্লার্কের বল মোকাবেলা করে ১৮ বছর বয়সী জর্জ হ্যাডলি ১৬, ৭১, ২১১, ৪০ ও ৭১ রান সংগ্রহ করেছিলেন।

ঐ সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটে আর কোন প্রথম-শ্রেণীর খেলা আয়োজন না করায় এক বছরে অলস সময় অতিবাহিত করেন। পরবর্তীতে স্ট্যান নিকোলস, জ্যাক মার্সার ও ইউয়ার্ট অ্যাস্টিলসমৃদ্ধ জুলিয়ান কানের দলটি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরে আসে। ২০ বছর বয়সী জর্জ হ্যাডলি জ্যামাইকার সদস্যরূপে ৫৭ ও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান একাদশের পক্ষে ১৪৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন।

এগুলোর কোন কিছুই হয়তো ঘটতো না যদি সঠিক সময়ে কাগজপত্র পেতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনে তাঁর পিতা-মাতা তাঁর কাছে পাঠালেও এর সময় পেরিয়ে যায়। এভাবেই দেশের সম্ভাবনাময় ক্রিকেট জগতের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন ও আজীবন সম্পর্ক গড়ে তুলেন। দ্বীপ এবং ক্রিকেটের ইতিহাসে সৌভাগ্য বয়ে আনে ও চিঠিটি দেরীতে আসে। তিনিও জীবনের ইপ্সিত লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।

এক পর্যায়ে সম্মানীয় ফ্রেডি ক্যালথর্পের অধীনে শক্তিধর এমসিসি দল দ্বিতীয়বারের মতো ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে আগমন করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁকে দলে রাখা হয়। ঘরোয়া ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলেও ঐ সময়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিল না। প্রত্যেক মাঠের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন দল নির্বাচকমণ্ডলী ও ভিন্ন ভিন্ন অধিনায়ক মনোনীত করা হতো।

চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২৮জন খেলোয়াড়কে খেলানো হলেও ক্লিফোর্ড রোচের সাথে তিনিও সবগুলো টেস্ট খেলার সুযোগে পান। ১৯২৯-৩০ মৌসুমে নিজ দেশে ইংরেজ দলের মুখোমুখি হন। ১১ জানুয়ারি, ১৯৩০ তারিখে বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে অভিষেক ঘটা সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। এরল হান্ট, এডউইন সেন্ট হিল, ফ্রাঙ্ক ডি কেয়ার্স, ডেরেক সিলি ও লেসলি ওয়ালকটের সাথে তাঁর একযোগে অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় তিনি ২১ ও ১৭৬ রান তুলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ০/১০ ও ০/৬ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলে চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ফলাফলবিহীন অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।

৮ ও ৩৯ রান তুলে ত্রিনিদাদে ব্যর্থতার পরিচয় দেন। গায়ানায় ১১৪ ও ১১২ রান তুলে দলের বড় ধরনের বিজয়ে বিরাট ভূমিকার স্বাক্ষর রাখেন। সবশেষে জ্যামাইকায় অসীম সময়ের টেস্টে অংশ নেন। ১০ ও ২২৩ রান তুলেছিলেন তিনি। ৮৩৬ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় অগ্রসর হয়েছিল তাঁর দল। তবে, পারস্পরিক সমঝোতায় খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয়। ঐ সিরিজে তিনি ৮৭.৮৭ গড়ে ৭০৩ রান তুলেছিলেন। এ পর্যায়ে তাঁকে বিল ভোস, নাইজেল হেগ, উইলফ্রেড রোডস ও ইউয়ার্ট অ্যাস্টিলের ন্যায় বোলারদের বল মোকাবেলা করতে হয়েছিল।

এরপর থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ক্রিকেট খেলা ব্যাহত হলেও ক্রিকেট বিশ্বের প্রকৃত মানসম্পন্ন তারকা ক্রিকেটারের মর্যাদা পান। অনভিজ্ঞ দলের সদস্যরূপে অন্যান্য খেলোয়াড় অস্বস্তির কবলে পড়লেও তাঁকে দূর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হতে হয়নি।

এমনকি অস্ট্রেলীয় ও ইংরেজ সমালোচকেরাও তাঁকে ডন ব্র্যাডম্যানের পর বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে মূল্যায়িত করতে থাকে। বিখ্যাত তারকা ক্রিকেটার ওয়ালি হ্যামন্ডের চেয়েও তাঁকে এগিয়ে রাখা হয়।

তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন সফলতায় ভরপুর ছিল। এমনকি প্রবল শক্তিধর অস্ট্রেলিয়া দলও তাঁর উপর ছড়ি ঘোরাতে পারেনি। ১৯৩০-৩১ মৌসুমে ক্যারিবীয় দলের সাথে অস্ট্রেলিয়া গমন করেন। নিউ সাউথ ওয়েলসের বিপক্ষে ২৫ ও ৮২ রান তুলে সফর শুরু করেন। এরপর মেলবোর্নে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ১৩১ রানের মনোজ্ঞ ইনিংস খেলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ একাদশ ইনিংস ব্যবধানে পরাভূত হলেও হিউ ট্রাম্বল মন্তব্য করেন যে, গত পঞ্চাশ বছরে তাঁর দেখা এটিই সেরা ইনিংস ছিল।

খুব শীঘ্রই অফ-সাইডের নির্দয় ব্যাটসম্যানরূপে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পান। ক্ল্যারি গ্রিমেট তাঁর শক্তিমত্তায় বাঁধার প্রাচীর গড়েন। তাঁকে অন-সাইডে খেলতে বাধ্য করেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে এ তরুণ ব্যাটসম্যান বিভ্রান্তির কবলে পড়েন। প্রথম দুই টেস্টসহ কয়েকটি খেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দেন। সিডনিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে স্পিনের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ান। শর্ট-লেগ ও মিড-অন বরাবরে বল ঠেলে দিতে থাকেন। বার্ট আয়রনমোঙ্গার ও ক্ল্যারি গ্রিমেট ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৯৩ রানে গুটিয়ে দিতে সহায়তা করলেও তিনি ১০২ রানে অপরাজিত ছিলেন।

শক্তিধর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ধারাবাহিকভাবে উপর্যুপরি চার টেস্টে পরাজয়বরণ করে তাঁর দল। অবশেষে সিডনিতে সিরিজের চূড়ান্ত টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয়ের মুখ দেখে। ছুটির দিনে বৃষ্টির সহায়তা নিয়ে প্রথম ইনিংসে ১০৫ রান তুলেন। এ সফর শেষে ক্ল্যারি গ্রিমেটের কাছ থেকে অন-সাইডে সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পান।

স্বতন্ত্র কোন ব্যাটিংয়ের দিকে তিনি ঝুঁকে পড়েননি। ১৯৩৩ সালে প্রথমবারের মতো দলের সাথে ইংল্যান্ড গমন করেন। ম্যানচেস্টার টেস্টে অপরাজিত ১৬৯ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস উপহার দেন। এ. র‍্যাটক্লিফ ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে ক্রিকেটার্স অ্যানুয়্যালে উল্লেখ করেন, ধীরগতির বোলিংয়ে তাঁর কাট বিস্ময়কর। এ ধরনের স্ট্রোক খেলে কেবলমাত্র একবার রয় কিলনারের বলে ফ্রাঙ্ক ওলি পুণঃপুণঃ বাউন্ডারি মেরেছিলেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা আয়োজনে অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ ক্রিকেট খেলাই বিদেশ সফরে ক্লাব পর্যায়ের খেলায় অংশ নিয়েছেন। সকল স্তরের ক্রিকেটেই দর্শকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড সফরে লর্ড টেনিসন তাঁর দলকে আবারও প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ এনে দেন। এ পর্যায়ে জর্জ হ্যাডলি তিন খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমটিতে অপরাজিত ৩৪৪, দ্বিতীয়টিতে ৮৪ ও অপরাজিত ১৫৫ এবং শেষটিতে ১৪০ রান তুলেন।

১৯৩৫ সালের শুরুতে ইংল্যান্ড দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আসলে প্রথম কয়েক টেস্টে তেমন ভালো খেলেননি। ৪৪, ০, ২৫, ৯৩ ও ৫৫ রান তুলে অন্য যে-কোনো ব্যাটসম্যানের তুলনায় ভালো করলেও নিজের নামের প্রতি অবিচার করেন। ১-১ ব্যবধানে থাকা অবস্থায় জ্যামাইকায় সফরকারীদের মুখোমুখি হন। নিজ দেশে নিজস্ব শেষ খেলাকে বেছে নেন তিনি। সোয়া আট ঘণ্টা ব্যাটিং করে ২৭০ রানে অপরাজিত ছিলেন। এরপর লিয়ারি কনস্ট্যান্টাইন ও ম্যানি মার্টিনডেলের বোলিংয়ে ইংল্যান্ড দল দুইবার কুপোকাত হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয়ের সন্ধান পায়।

পরবর্তী সিরিজে নিজস্ব শেষ খেলায় সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে এটিই শেষ বিদেশ সফর ছিল। ১৯৩৯ সালের গ্রীষ্মে ওয়ালি হ্যামন্ডের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ দলের মুখোমুখি হন তিনি। লর্ডসে তিনি ব্যতিক্রমধর্মী খেলা উপহার দেন। বিল বোস, হ্যাডলি ভ্যারিটি ও ডগ রাইটের বোলারদের মোকাবেলা করে ১০৬ ও ১০৭ রান তুলেন। এরফলে তিনি তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো উভয় ইনিংসে শতরানের সন্ধান পান।

অন্য কোন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান ২৫ রান তুলতে পারেনি। ওভালে সিরিজের শেষ টেস্টে ৬৫ রান তুলে রান-আউটে বিদেয় নেন। স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ শতরান তুলতে না পারায় হতবাক হয়ে পড়েন।

ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে পড়াকালীন ১৯ টেস্টে অংশ নিয়ে ১০ শতক সহযোগে ৬৬.৭১ গড়ে ২১৩৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। কমপক্ষে ৫ টেস্টে অংশ নেয়া দলীয় সঙ্গীদের মধ্যে কেবলমাত্র ক্লিফোর্ড রোচ ৩০.৭০ গড়ে থেকে পরবর্তী স্থানে ছিলেন। এ সময়কালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগৃহীত মোট রানের ২৬.৫ শতাংশ ও ১৫টি শতরানের দুই-তৃতীয়াংশ তিনি একাকী তুলেন। এমনকি স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানও নিজ দলে এ ভূমিকা রাখতে পারেননি। তাসত্ত্বেও, টেস্ট খেলোয়াড়ী জীবনে অমর্যাদাকর রেকর্ডের সাথে নিজেকে জড়ান। সর্বাধিক ৩৯৮ বল ডেলিভারি করে ২৩০ রান খরচ করেও কোন উইকেটের সন্ধান পাননি।

ঐ দশকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর আশার প্রতীকে পরিণত হন। জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি তাঁকে শ্বেতাঙ্গ বিশ্ব ও শ্বেতাঙ্গ ক্রীড়ায় কৃষ্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতাপ্রসূত ব্যক্তিত্বরূপে আখ্যায়িত করেন।

যথাসম্ভব অত্যন্ত গর্বের সাথে আফ্রিকান হিসেবে নিজের পরিচিতি তুলে ধরতেন। ১৯৩০-৩১ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রবেশকালীন আফ্রিকান হিসেবে পরিচয় দেন। এক পর্যায়ে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ে তাঁর উচ্চারিত কণ্ঠস্বর আরও বাস্তবরূপ ধারন করে। ক্রিকেটারদেরকে সাথে নিয়ে একসারিতে অবস্থান করে ষষ্ঠ জর্জের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতিহাসবেত্তা ফ্রাঙ্ক বিরবলসিং মন্তব্য করেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিরূপে তিনি আমাদের একজন হিসেবে রাজার সাথে হাত মেলাবেন। এরফলে উপনিবেশে জাতিগত নিকৃষ্টতা, মানসিক অধীনতা ও রাজনৈতিক শক্তিহীনতা দূরীকরণে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

যে-কোন দিক দিয়ে বিশেষতঃ ক্রিকেটীয় দক্ষতা ও সূক্ষ্ম বিচারশক্তি গুণে সন্দেহাতীতভাবে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখতেন। এ সময়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সকল অধিনায়ক সম্মিলিতভাবে তাঁর সংগৃহীত অর্ধ-শতকের সমান ইনিংস খেললেও তাঁদের কেউই তিন অঙ্কের সন্ধান পাননি। তাসত্ত্বেও লিয়ারি কনস্ট্যান্টাইনকে সাথে নিয়ে প্রশ্নাতীতভাবে শ্বেতাঙ্গদের অধীনে খেলেছেন।

যুদ্ধের পর জ্যামাইকার পিপলস ন্যাশনাল পার্টির উপনেতা নোয়েল নেদারসোল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের কাছে জর্জ হ্যাডলিকে অধিনায়কের স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। অবশেষে কর্তৃপক্ষ তাঁকে এক টেস্টের জন্যে অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। জানুয়ারি, ১৯৪৮ সালে বার্বাডোসে ইংল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক কেন ক্রান্সটনের সাথে টস করতে যান। এ মুহূর্তটি কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু, ঐ একটি টেস্টের জন্যেই তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়েছিল। হতবিহ্বল হয়ে পড়া ওয়ালি হ্যামন্ড মন্তব্য করেন যে, ‘তিনি সর্বাপেক্ষা অসাধারণ খেলোয়াড়ের পাশাপাশি সর্বাপেক্ষা অভিজ্ঞতাপুষ্ট ক্রিকেটার … এবং পুরো সিরিজে নড়বড়ে ও নিয়ন্ত্রণহীন দলের নেতৃত্বে না থাকার কোন কারণ দেখি না।’

৪২ বছর বয়সী জর্জ হ্যাডলিকে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে সেরা ব্যাটসম্যানের ছায়াচিত্রে পরিণত হতে দেখা যায়। প্রথম টেস্টে পিঠের আঘাতের ফলে সকলের কাছে সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান নিয়ে আসে। পরবর্তী খেলাগুলোয় তিনি অংশ নিতে পারেননি। দ্বিতীয় টেস্টে জেরি গোমেজ দলকে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় টেস্ট থেকে জন গডার্ডকে দলের নিয়মিত অধিনায়ক হিসেবে রাখা হয়। তিনিও তাঁদের সামনে থেকে খেলতে থাকেন। কিন্তু খুব কমই তাঁর খেলায় পরিবর্তন ঘটেছিল।

মূলতঃ ভারতীয় ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের সবিশেষ অনুরোধে ভারত সফরে আসেন। তবে, উদ্বোধনী টেস্টে ব্যর্থ হন। এরপর পাকিস্তান একাদশের বিপক্ষে খেলাকালীন আঘাত পান। ফলশ্রুতিতে আর কোন খেলায় অংশগ্রহণ করেননি। এরপর টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নিতে কেনসিংটন ও পরবর্তীতে বার্মিংহামে খেলেন।

হঠকারী সিদ্ধান্তে ও সাধারণের দাবীর প্রেক্ষিতে পুণরায় খেলার জগতে ফিরে আসেন। বার্মিংহাম লীগে ডাডলি দলের পক্ষে দারুণ ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখায় জ্যামাইকার জনগণের প্রত্যাশা আরও বেড়ে যায়। অতঃপর, ১৯৫৪ সালে লেন হাটনের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড দল ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে আসলে তাঁকে জ্যামাইকায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ডেইলি গ্লিনারের উদ্যোগে £১,০০০ পাউন্ড-স্টার্লিংয়ের আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠন করা হয়।

তবে, তিনি অনড় ছিলেন। কিন্তু জনসাধারণের দাবীই এতে প্রতিফলিত হয়। এমসিসি’র বিপক্ষে আর্থিক তহবিল গঠনের খেলায় কম্বাইন্ড পারিশের সদস্যরূপে খেলেন। ফ্রেড ট্রুম্যানের লাফিয়ে আসা বল হাতে আঘাত পান। এরফলে ইয়র্কশায়ারের ফাস্ট বোলার দর্শকদের চোখে খলনায়কে পরিণত হন। আঘাতের কারণে একটি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিতে পারেননি। এরপর জ্যামাইকার সদস্যরূপে এমসিসি’র বিপক্ষে খেলতে নেমে ৫৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। এরফলে, সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলার জন্যে তাঁকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

৪৫ বছর বয়সী জর্জ হ্যাডলি ব্যাট হাতে মাঠে নামেন। মাত্র ১৬ ও ১ রান তুলতে পেরেছিলেন। তাসত্ত্বেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল ঐ টেস্টে জয়লাভ করেছিল এবং অধিনায়ক জেফ স্টলমেয়ার আগস্টে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে তৎপর হন।

বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিন টেস্টে অংশ নিয়ে মাত্র ৫৫ রান তুলতেও সমর্থ হন। এরফলে তাঁর গড় ইনিংস প্রতি ছয় রান কমে যায়। তাসত্ত্বেও ২২ টেস্ট থেকে ৬০.৮৩ গড়ে ২১৯০ রান তুলে সর্বকালের গড়ের তালিকায় ডন ব্র্যাডম্যান ও গ্রায়েম পোলকের পর নিজেকে তৃতীয় স্থানে নিয়ে যান। সবগুলো প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নিয়ে ৬৯.৮৬ গড়ে রান তুলেছেন। এ পর্যায়ে কমপক্ষে ৫০ ইনিংসে অংশ নেয়া ব্যাটসম্যানের মধ্যে ডন ব্র্যাডম্যান ও বিজয় মার্চেন্টের পর তৃতীয় স্থানে অবস্থান করেন। প্রতি চার ইনিংসে একটি শতরানের ইনিংস খেলেছেন।

১৯৫৩-৫৪ মৌসুমে নিজ দেশে লিওনার্ড হাটনের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৫৪ তারিখে কিংস্টনে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ১৬ ও ১ রান সংগ্রহ করে উভয় ক্ষেত্রে টনি লকের শিকারে পরিণত হয়। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ০/২৩ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। স্বাগতিকরা ১৪০ রানে জয়লাভ করলে পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।

অন্যান্য সেরা খেলোয়াড়ের ন্যায় তিনিও ছোটখাটো ও মজবুত গড়নের অধিকারী ছিলেন। পিছনের পায়ের উপরে ভর রেখে খেলার পাশাপাশি প্রয়োজনে বলকে সপাটে আঘাত করতেন। বেশ আগেভাগেই বলকে দেখতে পেতেন। বোলারের হাত থেকে বল অবমুক্তির পর যতোটা দেরীতে সম্ভব খেলার প্রয়াস চালাতেন।

প্রায়শই ব্যাট অতিক্রান্ত হয়েছে ভেবে বোলারদের আবেদনের মাঝামাঝি সময়ে তাঁরা অবাক নয়নে লক্ষ্য করেন যে, শেষে মুহূর্তে বল সীমানার বাইরে চলে গেছে।

প্রথম বলেই স্পিনার বরাবরে উপরে দিয়ে একটি বাউন্সে গোচরীভূত পর্দায় ফেলার প্রবণতা ছিল। কখনোই তিনি বলকে ঠেলে দিতেন না, সজোরে আঘাত করতেন। দ্রুততার সাথে পদসঞ্চালনের পাশাপাশি ব্যাটিংয়ের গতিও ছিল উল্লেখ করার মতো।

প্রচলিত রয়েছে যে কেবলমাত্র ফিল্ডার নয়, বরঞ্চ তাঁদের পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে পূর্ণাঙ্গভাবে বলকে ফেলতেন। প্রায়শই ফিল্ডারের বিপরীতে বল ফেলে সুবিধে নিতেন। তিনি ক্রিকেট খেলতেন মানেই তিনি খেলতেন। সর্বোপরি মুক্তভাবে খেলা পরিহার করতেন।

খেলা চলাকালীন যখন দলীয় সঙ্গীরা মুক্তভাবে চলাফেরা করতো, তখন তিনি নিবিষ্টমনে প্রস্তুতি নিতেন, নীরবতা বজায় রাখতেন ও প্রায়শঃই ধূমপানে ব্যস্ত থাকতেন। প্রচলিত রয়েছে যে, প্যাভিলিয়ন থেকে ক্রিজে গমনকালে পথিমধ্যে স্বীয় পিতা স্বাক্ষাৎ করতে আসলেও তিনি তাঁকে চিনতেন না।

ক্রিকেটে তাঁর সফলতার বিষয়টি কেবলমাত্র বিস্ময়করভাবে সাফল্যের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল না। এগুলো তাঁকে অনেক দূর পিছনে নিয়ে গিয়েছিল। বর্ণ কিংবা মর্যাদা ভুলে তাঁর সাফল্যে প্রত্যেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান উজ্জীবিত হয়ে পড়ে।

১৯৩৪ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। এমবিই উপাধীতে ভূষিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। আরজিএ হ্যাডলি নামীয় সন্তানের জনক। ৩০ নভেম্বর, ১৯৮৩ তারিখে ৭৪ বছর ১৮৪ দিন বয়সে জ্যামাইকার মিডোব্রিজ এলাকায় তাঁর দেহাবসান ঘটে।