হানিফ মোহাম্মদ
২১ ডিসেম্বর, ১৯৩৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের গুজরাতের জুনাগড়ে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি দলের প্রয়োজনের উইকেট-রক্ষণে অগ্রসর হতেন। পাকিস্তান দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাকিস্তানী ক্রিকেটের প্রথম তারকা খেলোয়াড় ছিলেন। রান তোলার ক্ষেত্রে ডন ব্র্যাডম্যানের পর দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ‘লিটল মাস্টার’ ডাকনামে ভূষিত হন। দক্ষতা, কৌশল অবলম্বন, অপরিসীম দম, দৃঢ় মনোযোগের কারণে ক্রিকেটের ইতিহাসে অনন্য নজির গড়ে প্রকৃত ‘লিটল মাস্টার’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। পাকিস্তানী ক্রিকেটের পরিবর্তন আনয়ণে পথিকৃতের ভূমিকায় অংশ নেন। লাহোরের অভিজাত পরিবারের সন্তান তিনি। ক্রিকেট খেলাকে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তার লাভে সহায়তা করে বর্তমানের অবস্থানে নিয়ে আসেন। আল্ফ গোভারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তবে, তাঁর ব্যাটিং কৌশলে বিমোহিত হয়ে পড়েন।
১৯৫১-৫২ মৌসুম থেকে ১৯৭৫-৭৬ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর পাকিস্তানী ক্রিকেটে বাহাওয়ালপুর, করাচী ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৬ বছর বয়সে খেলোয়াড়ী জীবনের সূচনা ঘটান। এর এক বছর পর তাঁর টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে।
পাথরপ্রাচীর রক্ষণব্যূহ গড়ে তুলতেন। নিখুঁতমানের রক্ষণাত্মক কৌশল অবলম্বনের কারণে পরিচিতি লাভ করেন। বলকে তেমন শূন্যে ভাসিয়ে খেলতে উৎসাহবোধ করতেন না। তাসত্ত্বেও, প্রত্যেক বলই মোকাবেলা করতেন। কখনো কখনো মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। খুব সম্ভবতঃ রিভার্স-সুইপের প্রবর্তকের কৃতিত্বের অধিকার পেয়ে আসবেন। এছাড়াও, আরও কতক গুণাবলীর অধিকারী তিনি। দলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। উইকেট-রক্ষণেও এগিয়ে আসতেন। টেস্ট ক্রিকেটে ডানহাতি ও বামহাতি বোলিং করতে পারতেন। সবকিছু ছাঁপিয়ে তিনি অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ছিলেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি ধারন করে ১৯৫১ সালে আইসিসি কর্তৃক পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ সদস্যভূক্ত দলের মর্যাদা লাভের পর করাচীতে নাইজেল হাওয়ার্ডের নেতৃত্বাধীন এমসিসি’র বিপক্ষে ৬৪ রানে জয়লাভ করে। অনানুষ্ঠানিক ঐ টেস্টে সিন্ধু মাদ্রাসার ১৭ বছর বয়সী ছাত্র হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্রায়ান স্ট্যাদাম ও পিটার লোডারসমৃদ্ধ বোলারদের রুখে দিয়ে ৬৪ রানের মূল্যবান ইনিংস খেলেন।
১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সময়কালে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বমোট ৫৫ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫২-৫৩ মৌসুমে আব্দুল কারদারের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের সাথে ভারত গমন করেন। ১৬ অক্টোবর, ১৯৫২ তারিখে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা মাঠে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। খান মোহাম্মদ ও আমির ইলাহী ব্যতীত বাদ-বাকী সকলের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। পাকিস্তানের পক্ষে প্রথম অর্ধ-শতক হাঁকানোর কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। ৫১ ও ১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৭০ রানে জয় পেয়ে পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
তিন বছর পর বাহাওয়ালপুরে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে খেলেন। নিজ দেশে প্রথম শতরান করার গৌরবের অধিকারী হন। এছাড়াও, পাকিস্তানের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে তিন হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।
ব্যাট হাতে ব্যাটিং উদ্বোধনে নামতেন। অপরিচিত পরিবেশে অনেক ফাস্ট বোলার মুখোমুখি হয়েছেন। যেখানে অন্যেরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, সেখানে তিনি সফলতার সন্ধান পেয়েছেন। ১৯৫৪ সালের গ্রীষ্মে ইংল্যান্ড সফরে যান। লর্ডস টেস্টে ২০ ও ৩৯ রান তুলতে সক্ষম হন। এরপর, ওভালে ফজল মাহমুদের বিধ্বংসী বোলিংয়ে খেলায় ১২ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক জয়ে অংশ নেন। এরফলে, সিরিজটি ড্রয়ে পরিণত হয়।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সময়ের দিক থেকে দীর্ঘতম ইনিংস খেলে সুনাম কুড়িয়েছেন ও অদ্যাবধি তা অক্ষত রয়েছে। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে পাকিস্তান দল প্রথমবারের মতো ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে গমন করে। বার্বাডোসের ব্রিজটাউনে ছয় দিনব্যাপী টেস্টে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৭০ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করে ৩৩৭ রান সংগ্রহ করে দলকে নিশ্চিত পরাজয় থেকে রক্ষা করেন। ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডীয় ব্যাটসম্যান ব্রেন্ডন ম্যাককালামের দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০২ রান তোলার পূর্ব-পর্যন্ত একমাত্র ত্রি-শতক হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছিল।
রয় গিলক্রিস্ট, এরিক এটকিনসন, ডেনিস এটকিনসন ও গ্যারি সোবার্সের ফাস্ট বোলিং এবং আলফ্রেড ভ্যালেন্টাইন ও ও’নীল স্মিথের স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে রুখে ত্রি-শতরান করেন। মাঠের বাইরে বৃক্ষের শাখায় জনৈক কিশোর খেলা দেখে ঝিমুনীর কবলে পড়ে হাত ভেঙ্গে ফেলে। সংবাদপত্রে অবগত হলে দলনায়ক আব্দুল হাফিজ কারদার কিশোরকে দলের পাশে বসে মোহাম্মদ হানিফের ব্যাটিং দেখার আমন্ত্রণ জানান।
এক বছর পর জানুয়ারি, ১৯৫৯ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৪৯৯ রান তুলে রান আউটের শিকার হন ও তৎকালীন ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড নিজ নামের পার্শ্বে যুক্ত করেন। এ পর্যায়ে দিনের শেষ বলে ৫০০ রান সংগ্রহের দিকে ধাবমান ছিলেন। ৬৪০ মিনিট ক্রিজে অবস্থান করেছিলেন তিনি। প্রথম-শ্রেণীর কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে করাচী পার্সি ইনস্টিটিউট বনাম বাহাওয়ালপুরের মধ্যকার খেলায় এ কীর্তিগাঁথা রচনা করেন। এরফলে, নিউ সাউথ ওয়েলসের সদস্যরূপে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের ৪৫২ রান সংগ্রহের ৩৪ বছরের প্রাচীন রেকর্ড ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে, প্রায় ৩৫ বছর পর বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান তারকা ক্রিকেটার ব্রায়ান লারা ১৯৯৪ সালে ওয়ারউইকশায়ার বনাম ডারহামের মধ্যকার খেলায় ৫০১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে রেকর্ডটিকে নিজের করে নিয়ে যান। এ ধরনের কৃতিত্বগুলো বেতারে সম্প্রচারিত হয়।
১৯৬২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্টে দুইটি শতরানের ইনিংস খেলেন। এরফলে, পাকিস্তানের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে উভয় ইনিংসে শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন।
১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে পাকিস্তানের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন। এ পর্যায়ে দলকে নিয়ে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া গমন করেন। এটিই তাঁর একমাত্র ট্রান্স-তাসমান সফর ছিল। মেলবোর্নে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের একমাত্র টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১০৪ রান তুলেন। এরপর, দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৩ রান তুলে ব্যারি জার্মানের বলে স্ট্যাম্পিংয়ের কবলে পড়েন।
১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ড সফরে যান। ২২ জানুয়ারি, ১৯৬৫ তারিখে ওয়েলিংটনে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড দলের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে ৫ ও ২৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৬৭ সালের ইংল্যান্ড গমনার্থে দলকে নেতৃত্ব দেন। ঐ সিরিজে পাকিস্তান দল পরাজিত হয়। তাসত্ত্বেও ব্যক্তিগত সাফল্যে ভাস্বর ছিলেন। লর্ডসে জন স্নো, কেন হিগস, ডেরেক আন্ডারউডের ন্যায় বোলারদের মোকাবেলা করে ১৮৭ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন। ঐ মাঠে অন্যতম সেরা ইনিংসগুলোর এটি একটি।
১৯৬৯ সালে নিজ দেশে গ্রাহাম ডাউলিংয়ের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। করাচীতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে নিজস্ব ৫৫তম ও শেষ টেস্টে অংশ নেন। ২৪ অক্টোবর, ১৯৬৯ তারিখে অনুষ্ঠিত সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে কনিষ্ঠ সহোদর মুশতাক মোহাম্মদ ও অভিষেক ঘটা সাদিক মোহাম্মদের সাথে একত্রে অংশ নেন। এরফলে, ক্রিকেটের ইতিহাসে তৃতীয় ও সর্বশেষ ঘটনা হিসেবে তিন ভাইয়ের একই টেস্টে একযোগে অংশগ্রহণের ঘটনা ঘটে। ২২ ও ৩৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি উভয় হাতেই বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে জ্যামাইকার সাবিনা পার্কে অনুষ্ঠিত টেস্টে স্যার গারফিল্ড সোবার্সের অপরাজিত ৩৬৫ রানের নতুন রেকর্ড সৃষ্টিকালে তাঁকে লক্ষ্য করে ডান ও বাম – উভয় হাতে বল করেছিলেন। নিজের অভিষেক টেস্টে উইকেট-রক্ষণেরও দায়িত্ব পালন করেন।
১৮ বছরের বর্ণাঢ্যময় খেলোয়াড়ী জীবনে ৫৫ টেস্টে ৩৯১৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তন্মধ্যে, ১২টি শতক ও ১৫টি অর্ধ-শতক ছিল। পাকিস্তান দলকে ১১ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ২টিতে জয় ও ২টিতে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেন। অবসর পরবর্তী সময়কালে পাকিস্তান দলের সাথে যুক্ত থাকেন। দল নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতিসহ ২০০২-০৩ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে দলের ব্যাটিং কোচের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তিন বছর যকৃতের ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অতঃপর, ১১ আগস্ট, ২০১৬ তারিখে ৮১ বছর ২৩৪ দিন বয়সে করাচীতে তাঁর দেহাবসান ঘটে। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। ভ্রাতৃ চতুষ্টয় – ওয়াজির মোহাম্মদ, রইস মোহাম্মদ, মুশতাক মোহাম্মদ, সাদিক মোহাম্মদ; পুত্র – শোয়েব মোহাম্মদ, নাতি – শিজার মোহাম্মদ প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটের সাথে যুক্ত। তন্মধ্যে, রইস মোহাম্মদ একটি টেস্টে দ্বাদশ খেলোয়াড়ের দায়িত্ব পালন করেন। শিজার মোহাম্মদ বাদে সবাই টেস্ট ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।
১৯৬৮ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননায় ভূষিত হন। এছাড়াও, ২০২১ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড প্রণীত পাকিস্তান ক্রিকেট হল অব ফেমের উদ্বোধনী তালিকায় ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস ও জহির আব্বাসের সাথে অন্তর্ভুক্ত হন।