বিল ও’রিলি
২০ ডিসেম্বর, ১৯০৫ তারিখে নিউ সাউথ ওয়েলসের হোয়াইট ক্লিফসে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও সাংবাদিক ছিলেন। বিংশ শতাব্দীতে ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা লেগ-স্পিনারের মর্যাদা পেয়েছেন। স্পিন বোলিংয়ের তুলনায় ফাস্ট বোলিংয়ে নিজেকে অধিক সামলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।
অস্ট্রেলীয় লেগ-স্পিনার হিসেবে বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে বিরাট প্রভাব ফেলেছিলেন। অর্থোডক্স লেগ-স্পিনার হিসেবে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে ডান হাঁটু বাঁকিয়ে বোলিং কর্মে অগ্রসর হতেন। মুঠোয় বল পুড়ে বাউন্স করাতে পারতেন। এ ধরনের বোলিংয়ের পাশাপাশি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে গুগলি মারতেন।
নিজের সময়কালে সেরা বোলার ছিলেন। লেগ-স্পিন বোলিংয়ের পাশাপাশি ফাস্ট বোলিংয়ে অপূর্ব দক্ষতা দেখিয়েছেন। ১৯৩০-এর দশকে ব্যাটসম্যানদের উপযোগী পিচে বোলিংয়ে প্রভূত্ব ঘটিয়েছিলেন। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি দৈহিক উচ্চতা ও প্রশস্ত কাঁধের অধিকারী ছিলেন। টেস্টপ্রতি ৩৭১ বল করেছেন। তন্মধ্যে, বেশ কিছু বল ব্যাটিংবান্ধব পিচে করেছেন। কেবলমাত্র তাঁর তুলনায় স্পিন বোলিংয়ের অংশীদার ক্ল্যারি গ্রিমেট ৩৯২ বল করে এগিয়ে রয়েছেন। ডানহাতে বোলিং করলেও বামহাতে ব্যাটিং করতেন।
আইরিশ অভিবাসিত পরিবারে বিদ্যালয় শিক্ষক আর্নেস্ট পিটার ও’রিলি’র সাত সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। তাঁর মাতা মিনা ভিক্টোরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শৈশবকাল অতিবাহিত করেন ও সেখানেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি ঘটে। অপর তিন ভাইয়ের সাথে ক্রিকেট খেলেন। সর্বকনিষ্ঠ হবার সুবাদে তাঁকে সম্ভবত মাঠে অবস্থান করতে বাধ্য করা হতো। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতারা দীর্ঘক্ষণ বোলিং করতেন ও তাঁকে ব্যাটিংয়ের সুযোগ এনে দিত। গুলবার্ন হাই স্কুলে দুই বছর রেলগাড়ীতে চড়ে পড়তে যেতেন। এরপর, সেন্ট প্যাট্রিক্স কলেজে তিনি বছর পড়াশুনো করেন।
তাঁর লেগ-স্পিন তেমন দর্শনীয় ছিল না। ডানহাতে বল নিয়ে লেগ-ব্রেক, গুগলি ও পেস সহযোগে টপ স্পিন করতেন যা অনেকাংশে ফাস্ট-মিডিয়াম বোলিংয়ের ন্যায় ছিল। প্রায়শঃই বল বাউন্স খেতো। এ ধরনের বোলিংয়ের ফলে অতিকায় লেগ-স্পিনাররূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ও ‘টাইগার’ ডাকনামে পরিচিতি পান।
ডন ব্র্যাডম্যান তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, বিল ও’রিলি তাঁর দেখা সেরা বোলার ছিলেন। ডন ব্র্যাডম্যান ‘ফেয়ারওয়েল টু ক্রিকেট’ গ্রন্থে তাঁর বিষয়ে শিরোনামে উল্লেখ করেছেন যে, ‘দ্য ড্যাডি অব দেম অল’। অন্তরঙ্গ বন্ধু ও দলীয় সঙ্গী জ্যাক ফিঙ্গলটন তাঁর বোলিং ভঙ্গীমা সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, আঙ্গুলের আকস্মিক সঞ্চালন, ক্ষীপ্র দৃষ্টিভঙ্গী ও ইস্পাত কঠোর মেজাজে বোলিংয়ে অগ্রসর হতেন। এক পর্যায়ে অপ্রত্যাশিতভাবে বলকে নিচে ফেলতেন ও ব্যাটসম্যানের তা বুঝতে বেশ সময় লাগতো।
উইঙ্গেলো জুনিয়র্সের পক্ষে প্রথম খেলার সুযোগ পান। প্রতিপক্ষীয় মাঠ টলংয়ে যেতে দলটির সাথে সাত মাইল হাঁটেন। পুরো রাস্তায় তাঁদের কুকুরও গিয়েছিল। কলেজ জীবনে অ্যাথলেট হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। হপ, স্টেপ ও জাম্প – ত্রি-লম্ফে রাজ্য রেকর্ড গড়েন। এক পর্যায়ে সিডনির কিশোরদের খেলায় যুক্ত হলে পরবর্তীকালে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের অনন্য পরিচিতি আনয়ণে সক্ষম হন। ঐ খেলায় অপূর্ব ভঙ্গীমায় বোলিং করে দর্শকদের বিমোহিত করেন। তবে, ব্যাট হাতে সাফল্য লাভে ব্যর্থ হলে দল পরাজিত হয়।
১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে সিডনির টিচার্স কলেজে অধ্যয়নের জন্যে বৃত্তিধারী হন। ১৯২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে গ্রীষ্মে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাবিদ্যালয় থেকে স্নাতক-পূর্ব শ্রেণীতে কৃতকার্য হন। ডিসেম্বর, ১৯২৫ সালে নিজ এলাকা উইঙ্গেলোতে যাবার পথে বাউরেল স্টেশনে যান। পথিমধ্যে নিজ শহরের জনৈক খেলোয়াড়ের সাথে উৎসবের খেলায় বাউরেল যান। সেখানে উইঙ্গেলো ক্রিকেট দলের পক্ষে খেলেন। ঐ খেলায় প্রতিপক্ষ বাউরেলের বিপক্ষে দুইটি শনিবারে অনুষ্ঠিত হয়। বিল ও’রিলি তাঁর আত্মজীবনী ‘সিক্সটি ইয়ার্স অব ক্রিকেটে’ লেখেন যে, আমি তখনো জানতাম না যে, ক্রিকেট মাঠে বিখ্যাত ক্রিকেটারের সাথে খেলছি। দিন শেষে ১৭ বছর বয়সী ডন ব্র্যাডম্যান ২৩৪ রানে অপরাজিত ছিলেন। নিয়মমাফিক এক সপ্তাহ পর খেলা পুণরায় শুরু হলে আমি প্রথম বলেই তাঁকে বোল্ড করি। লেগ-ব্রেক বোলিংয়ে বলটি লেগ-স্ট্যাম্প থেকে বাঁক নিয়ে অফ-স্ট্যাম্পের বেইলে আঘাত করে। এটিই তাঁর সাথে বিল ও’রিলি’র প্রথম পরিচয় ঘটে। পরবর্তীতে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ততাপূর্ণ ছিল।
সিডনিতে বোটানি হ্যারিয়ার্সের সাথে অ্যাথলেটিক্সে অংশ নেন। হপ, স্টেপ ও জাম্পের ন্যায় ত্রি-লম্ফে বেশ ভালো করেন। দুই বছর মুর পার্কে ডেভিড জোন্স লিমিটেডের পক্ষে ক্রিকেট খেলেন। বোলিং গড়ে ঐ প্রতিযোগিতায় শীর্ষে আরোহণ করেন। শিক্ষক হিসেবে প্রথমবারের মতো আর্কাইভিল পাবলিক স্কুলে নিয়োগ পান। ১৯২৬-২৭ মৌসুমে নর্থ সিডনি ক্রিকেট ক্লাবের সদস্যরূপে যোগ দেন। প্রভূতঃ সফলতার স্বাক্ষর রাখলে ১৯২৭-২৮ মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলসের পক্ষে খেলার জন্যে মনোনীত হন। এরপর, পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ডিপার্টমেন্ট গ্রিফিথ, রাইলস্টোন ও ক্যান্ডোসের কান্ট্রি স্কুলে নিয়োগ দেয়। প্রথম গ্রেড ও প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে দূরে থাকলেও সহজে সনাক্ত করা যায় না ও অনিশ্চিত বাউন্সের ন্যায় রংআনে দক্ষ হয়ে উঠেন।
১৯৩০-এর দশকের পূর্ব-পর্যন্ত নিউ সাউথ ওয়েলসের পক্ষে নিয়মিতভাবে খেলার সুযোগ পেতেন না। খুব শীঘ্রই নিউ সাউথ ওয়েলসের পক্ষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। নিউজিল্যান্ডীয় একাদশের বিপক্ষে ঐ খেলায় তিন উইকেট দখল করেছিলেন। তিনটি ভিন্ন শহরে শিক্ষকতায় ব্যস্ত থাকার ফলে নিজ দেশে সফররত এমসিসি দলের বিপক্ষে ডন ব্র্যাডম্যানের অভিষেক হলেও তিনি খেলায় অংশ নিতে পারেননি। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড গমনের সুযোগ পেলেও পেশাগত ব্যস্ততা এতে বাদ সাধে।
১৯৩১ সালে কোগারা বয়েজ ইন্টারমিডিয়েট হাই স্কুলে নিযুক্ত লাভ করেন। এরফলে, নর্থ সিডনি ক্লাবে পুণরায় যোগ দেন। ১৯৩১-৩২ মৌসুমে রাজ্য দলের পক্ষে খেলেন। উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের শেষ দুই টেস্ট খেলার জন্যে মনোনীত হন। ঐ বছরের শেষদিকে সিডনিতে চলে যাবার অনুমতি পান। মজবুত গড়নের অধিকারী ছিলেন ও গুগলি বোলিংয়ে পারদর্শীতা দেখান।
১৯৩২ থেকে ১৯৪৬ সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বমোট ২৭ টেস্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩১-৩২ মৌসুমে নিজ দেশে জক ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের মুখোমুখি হন। ২৯ জানুয়ারি, ১৯৩২ তারিখে অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত সিরিজের চতুর্থ টেস্টে সফররত দক্ষিণ আফ্রিকা দলের বিপক্ষে অংশ নেন। পাড থার্লো ও বিল হান্টের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। এরপর থেকে তাঁকে আর দল থেকে বাদ দেয়া হয়নি। ঐ খেলায় সতীর্থ লেগ-স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেট ১৪ উইকেট পান, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসে ডন ব্র্যাডম্যান ২৯৯ রানে অপরাজিত থাকেন। স্বাগতিক দল ১০ উইকেটে জয় পায়। এরফলে, পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে স্বাগতিকরা ৪-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। তিনি চার উইকেট দখল করেছিলেন। দলে অংশগ্রহণের পরই উপলব্ধি করেন যে প্রোটেস্টান্ট ইংরেজ বংশোদ্ভূত দলে আইরিশ ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীকে সর্বদাই আগন্তুক হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়ে থাকে।
সব মিলিয়ে চারটি অ্যাশেজ সিরিজে অংশ নিয়েছিলেন। প্রত্যেক সিরিজেই ২০-এর অধিক উইকেট পেয়েছেন। ইংরেজদের বিপক্ষে তাঁর বোলিংশৈলীর অপূর্ব কলা প্রদর্শনের পাশাপাশি ব্যাটসম্যানদের তাঁকে মোকাবেলা না করার দৈন্যতা প্রকাশ পেয়েছিল। তন্মধ্যে, প্রথমটি ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের বিতর্কিত বডিলাইন সিরিজ ছিল। হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোসের দ্রুতগতিসম্পন্ন শর্ট-পিচ বোলিং একাধিপত্য বিস্তার করলেও তিনি ঐ সিরিজে ২৭ উইকেট পেয়েছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি পর্দার আড়ালে থাকলেও ঐ সিরিজে আট-বল নিয়ে গড়া ৩৬৩ ওভার বোলিংয়ের মাধ্যমে অপরিসীম ধৈর্য্য ও মেধার পরিচয় দেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। ৬ মে, ১৯৩৩ তারিখে প্যাডিংটনের ক্যাথলিক চার্চ অব সেন্ট ফ্রান্সিস অব অ্যাসিসিতে টাইপিস্ট মেরি অ্যাগনেস হার্বার্টের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। পরের বছর হার্স্টভিলে চলে যান ও সেখানে সেন্ট জর্জ ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দেন।
১৯৩৪ সালের গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়া দল ইংল্যান্ড গমন করে। ক্ল্যারি গ্রিমেটের সাথে শক্ত বোলিং জুটি গড়েন। ৭২ উইকেট পতনের ৫৩টি তাঁরা পান। তন্মধ্যে, এ সিরিজে ২৮ উইকেট দখল করে নিজেকে আরও উপরে নিয়ে যান। বাতাসের বিপরীতে তিনি মিডিয়াম পেস ও বাতাসে ক্ল্যারি গ্রিমেট আরও ধীরলয়ে বোলিং করতেন। উভয় স্পিনার তাঁদের নিখুঁতধর্মী বোলিংয়ে ব্যাটসম্যানদের উপর বিরাট প্রভাব ফেলেন।
ট্রেন্ট ব্রিজে চাতুর্যতার সাথে বলকে শূন্যে ভাসান ও স্পিনের সাথে পেসের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ৫৪ রান খরচায় সাত উইকেট দখল করে দলকে জয় এনে দেন। ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে এক ওভারেই বিরাটভাবে সফল হন। চার বলেই শীর্ষ তিনজন ব্যাটসম্যানকে বিদেয় করেন। প্রথম বলে সিরিল ওয়াল্টার্সকে শর্ট-লেগ অঞ্চলে কট আউটে বিদেয় করার পর দ্বিতীয় বলে বব ওয়াটের মাঝের স্ট্যাম্পে আঘাত হানেন ও চতুর্থ বলে ওয়ালি হ্যামন্ডকে বোল্ড করেন।
তবে, এ সফরে বিরাটভাবে সফলতার স্বাক্ষর রাখলেও দেশে ফিরে আকস্মিকভাবে অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। স্বীয় স্ত্রীকে সহায়তা করতে ও কিশোরী কন্যার দেখাশোনার দিকে নজর রাখার জন্যে শিক্ষকতা পেশার দিকে নিয়ে যাবার প্রত্যয় করেন। তবে, সিডনি গ্রামার স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলা চালিয়ে যাবার জন্যে একই পেশায় যুক্ত করার মাধ্যমে সহায়তার হাত প্রসারিত করে। এ প্রতিষ্ঠানে ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। আর্থিক সমস্যা দূরীকরণে খেলার দিনগুলোয় তাঁকে অর্ধ-বেতন দেয়া হতো।
১৯৩৫-৩৬ মৌসুমে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে ভিক রিচার্ডসনের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকা গমন করেন। ক্ল্যারি গ্রিমেটকে নিয়ে বোলিংয়ে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেন। এ সিরিজে অংশ নিয়ে ২৭ উইকেট পান।
১৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ তারিখে ডারবানে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি বল হাতে নিয়ে ৩/৫৫ ও ৫/৪৯ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, একবার ব্যাটিংয়ে নেমে ১১ রান সংগ্রহ করেন। ৯ উইকেটে জয়লাভ করলে সফরকারীরা পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়।
একই সফরের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬ তারিখে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত সিরিজের চতুর্থ টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার সন্ধান পান। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ৩০ রান অতিক্রম করেন। খেলায় তিনি একবার ব্যাট হাতে নিয়ে ৫৬* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ৫/২০ ও ০/২৬ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। ইনিংস ও ১৮৪ রানে জয়লাভ করলে সফরকারীরা পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে স্বীয় বন্ধু স্ট্যান ম্যাককাবে’র পরিচালনায় সিডনি স্পোর্টস স্টোরে যোগ দেন। পরবর্তীতে, ১৯৪০ সালে লায়ন টাইল কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের সচিব হন। ঐ প্রতিষ্ঠানে ছত্রিশ বছর ধরে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে যোগ দিতে পারেননি।
ক্লাব ক্রিকেটার হিসেবে তিনি দারুণ ছিলেন। ১৯৪৮-৪৯ মৌসুম পর্যন্ত প্রথম স্তরের ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩৯-৪০ মৌসুম থেকে উপর্যুপরী চার বছর সেন্ট জর্জের নেতৃত্ব দিয়ে শিরোপা জয়ে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৬ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত হলেও ১৯৫০ সালে তাঁকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। তিনি গোষ্ঠীগত আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করতেন। এরফলে, ১৯৪৬ সালে তাঁকে অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কত্ব থেকে উপেক্ষিত হতে হয়েছিল।
পরবর্তী অ্যাশেজ সিরিজটি সর্বকালের অন্যতম সেরা ছিল। ১৯৩৬-৩৭ মৌসুমে ইংল্যান্ড দল অস্ট্রেলিয়া সফর করে। এ সফরকে ঘিরে নেভিল কারডাস ‘অস্ট্রেলিয়ান সামার’ প্রকাশ করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়া দল ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ জয় করতে সমর্থ হয়। অস্ট্রেলীয় শিবিরে কোন্দলের মাধ্যমে সফর শুরু হয়। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডন ব্র্যাডম্যান অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন। তাঁর দীর্ঘদিনের বোলিং জুটি ক্ল্যারি গ্রিমেটকে দল থেকে বাদ দেয়া হয়। প্রতি টেস্টেই উভয়েই গড়ে পাঁচ উইকেট করে পেতেন। পুরো সফরেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার বোলিং বিভাগে ব্যাপক বোঝা টানতে বাধ্য হন।
মৃত্যুর পূর্বে এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি ক্ল্যারি গ্রিমেটকে দল থেকে বাদ দেয়ার জন্যে ডন ব্র্যাডম্যানকে দোষারোপ করেন। পাশাপাশি, সতীর্থ লেগ-স্পিনার ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে ডন ব্র্যাডম্যানের বিদেয় নেয়াসহ আর্নি ম্যাককরমিকের দ্রুতগতিসম্পন্ন বল মোকাবেলায় অনীহার বিষয়ে কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছেন। বিখ্যাত ব্যাটসম্যানের সাথে এটিই তাঁর প্রথম কিংবা শেষ ঝগড়া ছিল না। মতবিরোধ থাকলেও ঐ সিরিজের ২৫ উইকেট দখল করে দলের শীর্ষ উইকেট সংগ্রাহক ছিলেন। তন্মধ্যে, নিষ্পত্তিকৃত অ্যাডিলেড টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৩ উইকেট লাভ করেন।
১৯৩৭ সালের শুরুতে দলের চারজন সদস্যের অন্যতম হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের কাছ থেকে অধিনায়ক ডন ব্র্যাডম্যানকে অসহযোগিতার কারণে অভিযুক্ত হন। তিনি ধারনা করেন যে, ডন ব্র্যাডম্যান এ বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন ও পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে মন্তব্য করেন যে, আমি কখনোই তাঁকে ক্ষমা করবো না। তবে, ডন ব্র্যাডম্যান তাঁর সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে যান ও সাফল্যের পুণরাবৃত্তি ঘটান। এ সিরিজে ২২ উইকেট পান। লেন হাটনের ৩৬৪ রানের কল্যাণে ওভালে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ৯০৩/৭ করলেও তিনি ৮৫ ওভার বোলিং করে ৩/১৭৮ পান। লিডসে উভয় ইনিংসে পাঁচ-উইকেট নিয়ে সফরকারীদের জয় নিশ্চিত করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দৃশ্যতঃ তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন শেষ হয়ে পড়ে ও খেলোয়াড়ী জীবনের শেষদিকেও বর্ণাঢ্যময় খেলা উপহার দেন।
যুদ্ধ শেষ হবার পর ১৯৪৬ সালে আর একটিমাত্র টেস্টে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন। ১৯৪৫-৪৬ মৌসুমে বিল ব্রাউনের নেতৃত্বাধীন অজি দলের অন্যতম সদস্যরূপে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ড গমন করেন। কিউইদের বিপক্ষে টেস্টের ইতিহাসে এটিই অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী খেলা ছিল। ২৯ মার্চ, ১৯৪৬ তারিখে ওয়েলিংটনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের একমাত্র টেস্টে অংশ নেন। ৪০ ঊর্ধ্ব বয়স নিয়ে অভিজ্ঞতাবিহীন স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড দলের বিপক্ষে ৫/১৪ ও ৩/১৯ পান। চার-দিন নিয়ে গড়া ঐ টেস্টটি দুই দিনে শেষ হয়ে যায়। স্বাগতিক দল ৪২ ও ৫৪ রানে গুটিয়ে গেলে প্রতিপক্ষের কাছে ইনিংস ও ১০৩ রানে পরাভূত হয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়। বাম হাঁটুতে আঘাত পান। এ সফর শেষে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন ও স্মরণীয় করে রাখতে সাজঘরের জানালা দিয়ে নিজের জুতো ফেলে দেন।
স্বল্প অথচ দৃষ্টিনন্দন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়ী জীবনে অংশগ্রহণকৃত ২৭ টেস্টে ২২.৫৯ গড়ে ১৪৪ উইকেট পান। ১৯৩০-এর দশকে ব্যাটসম্যানের উপযোগী পিচে সন্দেহাতীতভাবে স্পিনার হিসেবে গড়ের দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অর্জনবিশেষ। তন্মধ্যে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চারটি অ্যাশেজ সিরিজ অংশ নিয়ে ১৯ টেস্ট থেকে পেয়েছেন ১০২ উইকেট। এ পর্যায়ে ওয়ালি হ্যামন্ডকে দশবার প্যাভিলিয়নে ফেরৎ পাঠিয়েছেন। ১৯২৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলেছেন। এ সময়ে ১৩৫টি খেলা থেকে ১৬.৬০ গড়ে ৭৭৪ উইকেট দখল করেছেন। এছাড়াও, ভিক্টর রিচার্ডসন একাদশ, বিল উডফুল একাদশ, স্ট্যান ম্যাককাবে একাদশ ও ডন ব্র্যাডম্যান একাদশের পক্ষে খেলেছেন।
১৯৩৫ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। ১৯৭১ সালে অফিসার অব দি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পদবীতে ভূষিত হন। ১৯৮০ সালে খেলোয়াড় ও লেখক হিসেবে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ওবিই পদবী লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে স্পোর্ট অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে তাঁর সম্মানার্থে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের প্যাট হিলস স্ট্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে বিল ও’রিলি স্ট্যান্ড রাখা হয়। ঐ বছর সিডনি মর্নিং হেরাল্ড সিডনি প্রতিযোগিতায় বছরের সেরা প্রথম স্তরের খেলোয়াড়কে পুরস্কৃত করার জন্যে ও’রিলি পদকের প্রবর্তন করে।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ক্রিকেট বিষয়ে লিখতেন। ১৯৪৬-৪৭ মৌসুমে ইংল্যান্ড দলের অস্ট্রেলিয়া সফরকে ঘিরে প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় ঝুঁকে পড়েন ও ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যান। শেষের বছরগুলোয় স্পিন বোলিংয়ের অনুপস্থিতির বিষয়ে ও সীমিত-ওভারের ক্রমাগত উত্তরণের বিপক্ষে ক্রমাগত লিখতে থাকেন। ক্যারি প্যাকারের পরিচালনায় একদিনের খেলার বিষয়টিকে ‘পায়জামা ক্রিকেট’রূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। সফরবিষয়ক দুইটি ও আত্মজীবনীধর্মী একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে খেলতে আসা নবাগত কুইন্সল্যান্ডীয় ক্রিকেটারের বিষয়ে তিনি তাঁর মাঝে টিকে থাকার আভাষের কথা বলতেন। কোন প্রতিশ্রুতিশীল লেগ-স্পিনারকে দল থেকে বাদ দিলে প্রকাশ্যে দল নির্বাচকমণ্ডলীর খামখেয়ালীর কথা তুলে ধরতেন।
সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ার পর সংবাদ কক্ষে দলীয় সঙ্গী জ্যাক ফিঙ্গলটনের সাথে যোগ দেন। এ দু’জন ডন ব্র্যাডম্যানের সমালোচনায় মুখরিত হতেন। নিজস্ব শেষ ইনিংসে ডন ব্র্যাডম্যান শূন্য রানে বিদেয় নিলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি বোর্ডের জনৈক সদস্যের কাছে অভিযোগ করেন যে, আপনি কি জানেন যে একজন প্রোটেস্টেন্টের অধীনে থেকে কাজ করছেন। ধর্মীয় দিক থেকে বিল ও’রিলি ও ডন ব্র্যাডম্যান ভিন্ন ছিলেন। তাসত্ত্বেও উভয়েই একে-অপরকে শ্রদ্ধা করতেন। তবে, তা খুবই সীমিত পর্যায়ের ছিল। ক্রিকেট ছাড়া খুব কমই দেখা স্বাক্ষাৎ হতো। ১৯৯৫ সালে জ্যাক ফিঙ্গলটন ও বিল ও’রিলি’র দেহাবসানের পর ডন ব্র্যাডম্যান লিখেন যে, তাঁরা বিদেয় নিলেও ১৯৪৮ সালে দলে থেকে ব্যাপক আনন্দ ও বড় ধরনের ভূমিকা রেখে সফরকে স্বার্থক করে তুলেছিলেন।
ডন ব্র্যাডম্যান তাঁকে তাঁর দেখা সেরা বোলার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি সহজাত ভঙ্গীমায় বলতেন, তুমি ঐ মূর্তিতে প্রস্রাব করতে পারবে না। মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে তিনি ডন ব্র্যাডম্যানের সাথে গ্রেগ চ্যাপেল ও অ্যালান বর্ডারের তুলনা করে বলেছেন যে তাঁরা ‘শিশুর খেলা’ প্রদর্শন করেছেন। ৬ অক্টোবর, ১৯৯২ তারিখে ৮৬ বছর ২৯১ দিন বয়সে সিডনির সাদারল্যান্ডের সিডনি হাসপাতালে বিল ও’রিলি’র দেহাবসান ঘটলে ডন ব্র্যাডম্যান মন্তব্য করেন যে, তিনি তাঁর দেখা সেরা বোলার বা সেরা খেলা দেখেছেন। ওরোনোরা সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে স্ত্রী, তিন কন্যা ও পুত্রকে রেখে যান।