মোতগনহালি জয়সীমা
৩ মার্চ, ১৯৩৯ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের সেকান্দারাবাদে জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার, কোচ ও প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছিলেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশকে টাইগার পতৌদি, সেলিম দুরানি’র ন্যায় ভারতীয় ক্রিকেটের শীর্ষ ১০জন তারকা ক্রিকেটারের অন্যতম ছিলেন। তন্মধ্যে, টাইগার পতৌদি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন চেহারার অধিকারী ছিলেন। সিল্কের শার্ট কব্জি অব্দি বোতামবদ্ধ রাখতেন ও কলার উঁচিয়ে রাখতেন। মাঠ ও মাঠের বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর অবস্থান ভাব-ভঙ্গীমায় ভরপুর ছিল।
১৯৫৪-৫৫ মৌসুম থেকে ১৯৭৬-৭৭ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে হায়দ্রবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৫ বছর বয়সে হায়দ্রাবাদের সদস্যরূপে অভিষেক ঘটে। ১৯৫৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় তিনি ৯০ রানের ঝকঝকে ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন। কয়েক মৌসুম ধারাবাহিকভাবে অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। রানের ফুলঝুড়ি ছোটানোর পাশাপাশি মিডিয়াম-পেস বোলিংয়েও দক্ষতার পরিচয় দেন। ফলশ্রুতিতে, ১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ড গমনার্থে তাঁকে ভারত দলের সদস্যরূপে ঠাঁই দেয়া হয়।
১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ৩৯ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে পঙ্কজ রায়ের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের সাথে ইংল্যান্ড গমন করেন। ১৮ জুন, ১৯৫৯ তারিখে লর্ডসে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। তেমন সুবিধে করতে পারেননি। প্রথম ইনিংসে ১ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং উদ্বোধনে নেমে ৮ রান সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ঐ টেস্টে স্বাগতিকরা ৮ উইকেট জয় পায় ও পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
১৯৫৯-৬০ মৌসুমে নিজ দেশে রিচি বেনো’র নেতৃত্বাধীন অজি দলের মুখোমুখি হন। ২৩ জানুয়ারি, ১৯৬০ তারিখে ইডেন গার্ডেন্সে অনুষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেয়ার পরবর্তী সুযোগ পান। সুযোগ পেয়েই ইতিহাস সৃষ্টিতে এগিয়ে আসেন। টেস্টের পাঁচদিনই ব্যাটিং করার কৃতিত্ব রয়েছে তাঁর। প্রথম দিনে রে লিন্ডওয়াল ও রিচি বেনো’র তোপে পড়ে দলের সংগ্রহ ১৪২/৭ থাকা অবস্থায় বেশ নীচেরসারিতে নয় নম্বর অবস্থানে ব্যাটিংয়ে নামেন। ঐ দিন শেষে ২ রানে অপরাজিত ছিলেন। দ্বিতীয় দিন সকালে ১৯৪ রানে ভারত দল গুটিয়ে গেলে তিনি ২০ রানে অপরাজিত থাকেন। অস্ট্রেলিয়া দল ৩৩১ রান তুললে তৃতীয় দিনের শেষ অধিবেশনে ভারত দল তাদের দ্বিতীয় ইনিংস খেলতে নামে। ৬৭ রানে দ্বিতীয় উইকেটের পতনের পর তিনি মাঠে নামেন ও কোন রান সংগ্রহ ছাড়াই দিন শেষ করেন। পরদিন উইকেট পতন অব্যাহত থাকলেও তিনি অনঢ় ছিলেন। প্রথমে বাপু নাদকর্ণী, পরবর্তীতে চান্দু বোর্দে ও শেষে রামনাথ কেনি’র সাথে জুটি গড়েন। একান্তই বাধ্য না হলে তিনি রান সংগ্রহ করতে এগিয়ে আসতেন না। পুরোদিন ব্যাটিং করে ৫৯ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় দিন শেষ করেন। এ পর্যায়ে ভারতের সংগ্রহ ছিল ২৪৩/৬। রিচি বেনো, রে লিন্ডওয়াল, অ্যালান ডেভিডসন, ইয়ান মেকিফ ও কেন ম্যাকে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও তাঁকে পরাস্ত করতে পারেননি। অবশেষে চূড়ান্ত দিনে কেন ম্যাকে তাঁর প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙ্গে তাঁকে ৭৪ রানে বিদেয় করেন। কিন্তু, দলের অবস্থান তখন মজবুত আকার ধারণ করে। এরফলে, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টের পাঁচ দিনই ব্যাটিং করার গৌরব অর্জন করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য আরও ছয়জন এ দূর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালেও সফরকারীরা ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়।
একই মৌসুমে কানপুরে সফরকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে পরের টেস্টে অংশ নেন। ইনিংস উদ্বোধনে নেমে ৯৯ রান তুলে পঞ্চম ব্যাটসম্যান হিসেবে রান-আউটের কবলে পড়েন। তাঁর ধ্রুপদীশৈলীর ব্যাটিং ইতোমধ্যে সকলের নজর কাড়ে। পঙ্কজ রায়ের খেলোয়াড়ী জীবনের শেষদিকে নিজেকে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে নিজ দেশে জন রিডের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ২ মার্চ, ১৯৬৫ তারিখে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে সফররত নিউজিল্যান্ড দলের বিপক্ষে খেলেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের ছোঁয়া পান। দ্বিতীয় ইনিংসে ৮ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ১৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ৫১ ও ৪৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ১/৩০ ও ০/৮ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৬৮ সালে বিমান থেকে অবতরণ করেই ব্রিসবেন টেস্টে শতক হাঁকান। ১৯৬৭-৬৮ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে মনসুর আলী খান পতৌদি’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮ তারিখে ডুনেডিনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি ১৭ ও ১১* রান সংগ্রহ করেছিলেন। স্বাগতিকরা ৫ উইকেটে পরাজয়বরণ করলে চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
একই সফরের ৭ মার্চ, ১৯৬৮ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে নিজেকে জড়ান। প্রথম ইনিংসে ৭ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ২০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। ১৯ ও ১* রান সংগ্রহ করেছিলেন। ০/১৪ ও ০/৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। সফরকারীরা ২৭২ রানে জয় পেলে ৩-১ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়।
১৯৭১ সালে অজিত ওয়াড়েকরের নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের সাথে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরে যান। ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে পোর্ট অব স্পেনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ০ ও ২৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালেও সফরকারীরা ১-০ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
সাতজন খেলোয়াড়ের অন্যতম হিসেবে বিসিসিআই থেকে মরণোত্তর সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। তাঁর খেলা অনুসরণ করেই মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন ও ভিভিএস লক্ষ্মণের ন্যায় খেলোয়াড়দের উপর অনুকূল প্রভাব পড়ে। তড়িৎগতিতে ফিল্ডিং ও কব্জীর মোচড়ে বলকে ঠেলে দিতেন। স্যার গারফিল্ড সোবার্সের সাথে একত্রে গল্ফ খেলেছেন। এমসিসি’র আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত সদস্যের মর্যাদা পেয়েছেন।
৬ জুলাই, ১৯৯৯ তারিখে অন্ধ্রপ্রদেশের সানিকপুরি এলাকায় ৬০ বছর ১২৫ দিন বয়সে তাঁর দেহাবসান ঘটে।