১২ অক্টোবর, ১৯১১ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বোম্বেতে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে মিডিয়াম বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ভারতের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন।
খুব কমসংখ্যক লোকই তাঁর প্রকৃত নাম বিজয়সিংহ মাধবজী থ্যাকার্সে সম্পর্কে অবগত আছেন। বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে তাঁকে নেয়া হলে ইংরেজ প্রিন্সিপাল তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করেন। বিজয় থ্যাকার্সে বললে প্রিন্সিপাল উক্ত নামের অর্থ জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন যে, ‘মহোদয়, আমরা ব্যবসায়ী পরিবার।’ এভাবেই বিজয় মার্চেন্ট নামটি সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করে। ১৯২৯-৩০ মৌসুম থেকে ১৯৫০-৫১ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে হিন্দু ও বোম্বে দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
ভারতের প্রথমদিকের সেরা ব্যাটসম্যান। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে বোম্বের তারকা খেলোয়াড় ছিলেন। দীর্ঘ ১৮ বছরের খেলোয়াড়ী জীবনে স্বল্পসংখ্যক খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ও ৪৭.৭২ গড়ে ৮৫৯ রান তুলেন। তাসত্ত্বেও, অদ্যাবধি ভারতের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে পরিগণিত করা হয়। তবে, প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানোচিত খেলেছেন। ডন ব্র্যাডম্যানের সাফল্যে উজ্জ্বীবিত হয়ে পরিসংখ্যানগতভাবে নিজেকে বেশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
ঘরোয়া আসরের ক্রিকেটে বিস্ময়কর রেকর্ড সৃষ্টি করেন। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বকালের সেরাদের তালিকায় দ্বিতীয় সেরা ব্যাটসম্যানের মর্যাদা পেয়েছেন। খুব বেশী ক্রিকেট খেলতে না পারলেও প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর গড় বেশ ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। ১৫০ খেলায় অংশ নিয়ে ৪৫ শতক সহযোগে ৭১.৬৪ গড়ে রান পেয়েছেন। এরফলে, ব্র্যাডম্যানের ৯৫.১৪ গড়ের পর তাঁর গড় অবস্থান করছে। তবে, দূর্ভাগ্যবশতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্থবির হয়ে পড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কারণে নিজেকে যথার্থ মেলে ধরতে পারেননি। ডন ব্র্যাডম্যানের ন্যায় তিনিও কেবলমাত্র নিজ দেশে ও ইংল্যান্ডের মাটিতে পুরো টেস্ট খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। তবে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অংশগ্রহণকৃত টেস্টগুলো একপেশে ছিল।
ব্যতিক্রমী পদসঞ্চালনে তাঁর ব্যাটিং কৌশল গ্রহণ যথোপযোগী ছিল। ড্রাইভ, লেট কাট, লেগ-গ্ল্যান্স, হুক অপূর্ব ও শ্রেয়তর ছিল। উপযোগী উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান না থাকায় তাঁকে ইনিংস উদ্বোধনে নামতে হয়। ১৯৩৬ সালে ভারতীয় দলের সাথে ইংল্যান্ড গমন করেন। এ সিরিজে ৪৭ গড়ে ২৮২ রান তুলেছিলেন। উইজডেন কর্তৃক বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। দলের নেতৃত্বে থাকা সিবি ফ্রাই মন্তব্য করেন যে, ‘তাঁকে শ্বেতাঙ্গ করে দাও ও অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে আমাদের দিয়ে দাও।’
১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতের ইতিহাসের উদ্বোধনী টেস্ট হয়তোবা খেলতে পারতেন। তবে, মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য স্বাধীনতাকামীকে গণহারে কারাগারে প্রেরণের প্রতিবাদে বাদ পড়েন। সব মিলিয়ে ৭১.৬৪ গড়ে ১৩৪৭০ রান সংগ্রহ করেছেন। রঞ্জী ট্রফিতে বোম্বের প্রতিনিধিত্ব করে ৯৮.৩৫ গড়ে ৩৬৩৯ রান পেয়েছেন।
১৯৩৩ থেকে ১৯৫১ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ১০ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে নিজ দেশে মাঝারিসারির ব্যাটসম্যান হিসেবে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বে সফররত এমসিসি দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পান। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৩ তারিখে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে এল.পি. জয়, লালা অমরনাথ, লধা রামজী ও রুস্তমজী জামসেদজী’র সাথে তাঁর একযোগে অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় ভারত দল ৯ উইকেটে পরাজয়বরণ করে ও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে।
১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে ভারতের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে অংশ নেন। এ সফর শেষে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের মর্যাদাপ্রাপ্ত হন। রঞ্জী ট্রফিতে তিনি ব্যাপক সাফল্য পান ও প্রতিযোগিতায় তিনি রঞ্জী ট্রফির ব্র্যাডম্যানরূপে চিত্রিত হন। ঐ প্রতিযোগিতায় ৯৮.৭৫ গড়ে ৩৬৩৯ রান তুলেন। তুলনান্তে, শচীন তেন্ডুলকর ৮৫.৬২ গড়ে ৪২৮১ রান সংগ্রহ করেছিলেন।
দূর্বল স্বাস্থ্যগত কারণে ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া গমন থেকে বিরত থাকেন। এরফলে, ডন ব্র্যাডম্যানসহ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের কাছ থেকে মনক্ষুণ্ন হন। বিখ্যাত ব্যক্তি লেখেন: ‘সবচেয়ে বাজে দিক হলো আমরা বিজয় মার্চেন্টকে দেখতে পাইনি। তিনি অবশ্যম্ভাবী ভারতীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরা ছিলেন।’
ভারতের প্রবীণতম শতকধারী হন। তিনটি টেস্ট শতরান পান। তন্মধ্যে, দুইটি এসেছে ৫ বছরের বিরতির পর শেষ দুই ইনিংস থেকে। ১৯৫১-৫২ মৌসুমে নিজ দেশে নাইজেল হাওয়ার্ডের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ২ নভেম্বর, ১৯৫১ তারিখে দিল্লির কোটলায় অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। নিজের শেষ টেস্ট খেলাকালীন তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর ২১ দিন। ঐ টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৫৪ রান তুলেন। অদ্যাবধি, ভারতের জ্যেষ্ঠতম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে এ সাফল্য পান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
জন আর্লট তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘তাঁকে ছয়টি বাজে বল দিলে প্রত্যেকটিতেই চার মারবেন। ছয়টি ভালোমানের বল দিলে তিনি প্রত্যেকটিই আটকে দিবেন।’ সেরা ক্রিকেটারের তকমা লাগানোর পাশাপাশি মানবতাবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুধীর বৈদ্য উল্লেখ করেছেন যে, মানবমুখী কর্মকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা প্রসঙ্গে শুনেছেন। ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। আমি কোন মন্দিরে যাই না। বিছানায় যাবার পূর্বে ঐ দিন আমি কিরূপ মানবকর্মে সম্পৃক্ত ছিলাম তার চিন্তা করি। একটি কিংবা দুইটি ঘটনা স্মরণ করেই সন্তুষ্ট হই। এটিই আমার ঈশ্বরের প্রতি সেবা। কোন কারণে এর ব্যতয় ঘটলে আমি ঘুমোতে পারি না।’
ভিক্ষুককে অর্থ কিংবা খাদ্য সহায়তাদানে অন্যদেরকে নিরুৎসাহিত করতেন। তিনি তাঁদেরকে নিজ কারখানা হিন্দুস্তান স্পিনিং ও ওয়েভিং মিলসে ভিক্ষুকদেরকে প্রেরণের কথা বলেন। ‘যথাসম্ভব আমার কারখানায় তাঁদেরকে নিয়ে এসো, আমি তাঁদেরকে স্থায়ী আয়ের জন্যে চাকুরী দিব। আপনার সহায়তায় হয়তোবা ভিক্ষুক সাময়িকভাবে সন্তুষ্ট হবে, তবে, আমি তাঁদেরকে স্থায়ী সমাধান এনে দিব।’ অক্ষম ব্যক্তিদের সহায়তাকল্পে প্রতিষ্ঠিত ন্যাসিও’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে, ভারত সরকার কর্তৃক জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার খেলা চলাকালীন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে কিছু হট্টগোলে থেমে যায়। পরবর্তীতে, মহারাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী শঙ্কররাও চবন তাঁকে উত্তেজিত দর্শকদেরকে শান্ত করতে তাঁকে অনুরোধ করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে ও খেলা পুণরায় শুরু হয়।
১৯৩৩ সালে এমসিসি দল প্রথমবারের মতো ভারত সফরে আসে। তাঁর ভগ্নী লক্ষ্মী স্ব-লেখন আনতে মহাত্মা গান্ধীর কাছে যান। কাকতালীয়ভাবে লক্ষ্মীর কাছে থাকা ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে এমসিসি দলের স্বাক্ষরযুক্ত গ্রন্থে তিনি স্বাক্ষর করেন। এভাবে মহাত্মা গান্ধী দলের সপ্তদশ সদস্যরূপে বিজয় মার্চেন্টের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন।
এছাড়াও, দল নির্বাচক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণের আট বছর পর ১৯৬০ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করা হয়। ‘ক্রিকেট রিপ্লেড’, ‘মাই স্টোরি এন্ড এ লং ইনিংস’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এমসিসি’র সম্মানসূচক সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। ২০০২-০৩ মৌসুমে রঞ্জী ট্রফিতে একদিনের খেলার ব্যবস্থা করা হলে তাঁর অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে বিজয় হাজারে ট্রফি নামকরণ করা হয়।
৭ অক্টোবর, ১৯৮৭ তারিখে মহারাষ্ট্রের বোম্বেতে হৃদযন্ত্রক্রীয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭৬ বছর ১৫ দিন বয়সে তাঁর দেহাবসান ঘটে।