বিজয় হাজারে
১১ মার্চ, ১৯১৫ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মহারাষ্ট্রের সাংলী এলাকায় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে মিডিয়াম বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। ভারত দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ভারতের অন্যতম কিংবদন্তীতূল্য ব্যাটসম্যান। চীরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও দলীয় সঙ্গী বিজয় মার্চেন্টকে সাথে নিয়ে বোম্বে স্কুলের অগ্রযাত্রায় অংশ নেন। ভারতীয় ক্রিকেটের শুরুর বছরগুলোয় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ক্ল্যারি গ্রিমেটের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। দর্শনীয় ও শিল্পসত্তা সহযোগে ব্যাটিংয়ের কারণে পরিচিতি পাননি। তবে, রান সংগ্রহ ও ধারাবাহিকতা রক্ষার কারণে ভারতীয় ক্রিকেটে তাঁর ভূমিকা অনবদ্য ছিল। তাঁর খেলার মান অনেকাংশেই ডন ব্র্যাডম্যান ও লেন হাটনের অনুরূপ ছিল।
বিদ্যালয় শিক্ষকের আট সন্তানের অন্যতম। শৈশবকাল থেকেই পড়াশুনোর চেয়ে ক্রিকেট ও ফুটবলেই অধিক মেতে থাকতেন। মিডিয়াম-পেসার হিসেবে খেলোয়াড়ী জীবনের সূত্রপাত ঘটান। পাশাপাশি লেগ-স্পিন বোলিং করতেন। সাংলী হাইয়ের ক্রিকেটার হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান। ১৯৩৪-৩৫ মৌসুম থেকে ১৯৬৬-৬৭ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে বরোদা, সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া ও মহারাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৩৪-৩৫ মৌসুমের রঞ্জী ট্রফি প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী আসরে মহারাষ্ট্রের পক্ষে অভিষেক ঘটে। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের ঐ প্রতিযোগিতায় নিচেরদিকে ব্যাটিংয়ে নামতেন ও মিডিয়াম-পেস বোলিং করতেন।
ঐ সময়ে দিয়াসের মহারাজা বিক্রম সিংয়ের অধীনে কাজ করতেন। কিংবদন্তীতুল্য লেগ-স্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেট অস্ট্রেলিয়া দল থেকে বাদ পড়লে মহারাজার আত্মীয় জাঠের রাজা সাহেব গুগলি বিষয় শেখাতে আমন্ত্রণ জানান ও রাজার পরামর্শক্রমে তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। টেনিস বলে ক্ল্যারি গ্রিমেট তাঁকে পরাস্ত করেন ও রক্ষণশৈলী সম্পর্কে পরামর্শ দেন। খুব দ্রুত কৌশলের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত হন। বোলিংয়ে গুগলি যুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রিমেট তাঁকে ব্যাটিংয়ে মনোনিবেশ ঘটানোর কথা বলেন।
১৯৩৩ সালের শেষদিকে পুনাতে অনুষ্ঠিত খেলায় মহারাষ্ট্রের সদস্যরূপে এমসিসি’র বিপক্ষে খেলেন। মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে চারটি উইকেট নিয়ে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তন্মধ্যে ব্রায়ান ভ্যালেন্টাইন ও আর্থার মিচেলের উইকেট ছিল। তবে, ঐ খেলাটি প্রথম-শ্রেণীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল না। ১৯৩৭ সালে লাহোরে লর্ড টেনিসনের নেতৃত্বাধীন দলের বিপক্ষে অনানুষ্ঠানিক টেস্টে অংশ নেন। পরবর্তী দুই দশক ব্যাটিং সাফল্যের কারণে নিয়মিতভাবে সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়েছেন।
১৯৩৮ সালে রাজপুতানা দলের সদস্যরূপে ইংল্যান্ড গমন করেন। কেমব্রিজ দলের বিপক্ষে শতক হাঁকান। ঐ খেলায় নরম্যান ইয়ার্ডলিকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে বিদেয় করেছিলেন। রটেনসলের সদস্যরূপে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগ ও ওরস্লি কাপে ৬২ খেলায় অংশ নিয়ে দুই শতক ও ২০টি অর্ধ-শতক সহযোগে ২৩৬০ রান এবং ২০বার পাঁচ-উইকেটসহ ১৮৬ উইকেট দখল করেন। ১৯৪৯ সালে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগের এক মৌসুমে দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে সহস্র রান ও শত উইকেট পান। মাত্র এক খেলা পূর্বে সেক পিপার এ অর্জনের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন।
রঞ্জী ট্রফি প্রতিযোগিতায় বরোদা, সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস ও কৈশোরকালীন সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। ১৯৩৫-৩৬ মৌসুমে জ্যাক রাইডারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলীয় একাদশের অনানুষ্ঠানিক সফরে খেলার জন্যে মনোনীত হন। ১৯৪০ সালের শুরুতে ঘরোয়া আসরে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেন। মহারাষ্ট্রের সদস্যরূপে বরোদার বিপক্ষে ৩১৬ রান করেন। পরের মৌসুমে বরোদা দলে চলে যান। বাঘ শিকারী হিসেবে পরিচিতি পান ও বরোদার মহারাজা প্রতাপসিংহরাও গায়কোয়াড়ের সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে যুক্ত থাকেন। এ সময় থেকেই ভারতের প্রথমদিকের সেরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান বিজয় মার্চেন্টের সাথে স্নায়ুযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনবার মধ্যাহ্নভোজনের পূর্বেই শতক হাঁকানোর কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। পঞ্চদলীয় প্রতিযোগিতায় বাদ-বাকী দলের পক্ষে খেলেছেন। ১৯৪১-৪২ মৌসুমে বোম্বে পেন্টাগুলারে হিন্দুর সদস্যরূপে মুসলিমের বিপক্ষে খেলে বিজয় মার্চেন্ট ২৪৩ রান তুলে তৎকালীন ভারতীয় প্রথম-শ্রেণীর রেকর্ড গড়লে পরের আসরে তিনি বাদ-বাকী দলের সদস্যরূপে একই দলের বিপক্ষে ২৪৮ রান তুলে নিজেকে এগিয়ে রাখেন। ১৯৪৩ সালের প্রতিযোগিতায় ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত খেলায় বিজয় মার্চেন্ট হিন্দু দলের পক্ষে ২৫০ রান তুলে তাঁর রেকর্ড ভঙ্গ করেন ও তিনি প্রতিপক্ষের সংগৃহীত ৫৮১ রানের বিপরীতে বাদ-বাকী দলের সদস্যরূপে ঐ ইনিংসে ৫২ ওভার বোলিং করেন। ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমের চূড়ান্ত খেলায় দূর্দান্ত খেলেন। প্রথম ইনিংসে ১৩৩ রানে গুটিয়ে যাওয়া দলটিতে ৫৯ রান তুলেন। ইনিংস পরাজয়ের মুখোমুখি হওয়া দলটি দ্বিতীয় ইনিংসে বাদ-বাকী দলের সংগ্রহ ৩৮৭ হলেও হিন্দু দলের বিপক্ষে একাই করেছিলেন অসাধারণ ও বিস্ময়কর ৩০৯ রান।
স্বল্পসংখ্যক ভারতীয় ক্রিকেটারদের অন্যতম হিসেবে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫০০০ রান ও ৫০০ উইকেট লাভের ন্যায় ‘ডাবল’ লাভ করেছেন। সব মিলিয়ে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৬০ শতক সহযোগে ৫৮.৩৮ গড়ে ১৮৭৪০ রান পেয়েছেন। ইনিংসে সেরা বোলিং পরিসংখ্যান গড়েছেন ৮/৯০। একই খেলায় ত্রি-শতক হাঁকিয়েছিলেন। প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ত্রি-শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন। রঞ্জী ট্রফি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত খেলায় বরোদার সদস্যরূপে গুল মাহমুদের সাথে ৫৭৭ রানের জুটি গড়েন। ১৯৪৭ সালে হোলকারের বিপক্ষে তাঁরা এ সফলতা পান। প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে যে-কোন উইকেটে রেকর্ডসংখ্যক জুটির মর্যাদা লাভ করেছিল। ৫৯ বছর পর ২০০৬ সালে কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৬২৪ রান তুলে রেকর্ডটি নিজেদের করে নেন। প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে দুইবার ত্রি-শতক করেছেন। মহারাষ্ট্রের বিপক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩১৬ রান তুলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্থবিরতা নেমে আসলেও ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট চলমান ছিল। বিজয় মার্চেন্টের সাথে তিনিও বোম্বে দলের রান সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা রাখেন। তাঁদের খেলা দেখতে প্রায় বিশ থেকে ত্রিশ হাজার দর্শক বোম্বের ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকতো। ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমে স্বর্ণালী সময় অতিবাহিত করেন। ১৪২৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। ২৬১, ৮১, ৯৭, ২৪৮, ৫৯, ৩০৯, ১০১ ও ২২৩ রান তুলে অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছিলেন। মাত্র চার খেলা থেকে ২৪৮, ৫৯, ৩০৯, ১০১, ২২৩ ও ৮৭ রান তুলে সহস্র রানের সন্ধান পান। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয় মার্চেন্ট তাঁর ২৪৮ রান দুই রানের ব্যবধানে এগিয়ে গেলে তিনি ৩০৯ রান তুলে এগিয়ে যান।
১৯৪৬ থেকে ১৯৫৩ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ৩০ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ভারতের প্রথম টেস্ট বিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে ইফতিখার আলী খান পতৌদি’র নেতৃত্বে ভারত দল ইংল্যান্ড গমন করে। ঐ সফরে ইয়র্কশায়ারের বিপক্ষে ফিরতি খেলায় ২৪৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন।
৩১ বছর বয়সে ২২ জুন, ১৯৪৬ তারিখে লর্ডসে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। বিনু মানকড়, রুসি মোদি, সাদু সিন্ধে, আব্দুল কারদার ও গুল মোহাম্মদের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় তিনি ৩১ ও ৩৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ২/১০০ ও ০/৭ বোলিং বিশ্লেষণ গড়ার পাশাপাশি একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। স্বাগতিক দল ১০ উইকেটে জয় পায় ও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ঐ সিরিজে ৪৯.৭৭ গড়ে ১৩৪৪ রান সংগ্রহসহ ২৪.৭৫ গড়ে ৫৬ উইকেট দখল করেছিলেন।
টেস্ট ক্রিকেটে ভারতের প্রথম বিজয়কালে অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫১-৫২ মৌসুমে মাদ্রাজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এ সফলতা পান। তবে, অধিনায়ক হিসেবে এটিই তাঁর একমাত্র জয়লাভ ছিল। কিছুটা লাজুক প্রকৃতির ছিলেন ও অধিনায়কত্ব লাভ করা তাঁর পক্ষে খুব সহজে আসেনি। টেস্টে ৪৭ ঊর্ধ্ব গড়ে রান পেলে ভারতের অধিনায়ক হিসেবে তাঁকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বলে ধারনা করা হয়। তবে, এরফলে তাঁর ব্যাটিংয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিখ্যাত ইংরেজ ফাস্ট বোলার ব্রায়ান স্ট্যাদাম তাঁর আত্মজীবনী ‘ফ্লাইং বলসে’ ১৯৫১-৫২ মৌসুমে ভারতে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফর সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, ‘বিজয় মার্চেন্ট ও বিজয় হাজারে’র মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ টেস্টে বড় অঙ্কের রান সংগ্রহে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। তবে, এ ধরনের সংঘাত ভারতের জন্যে সর্বদা মঙ্গলদায়ক নয়।’
ফিরোজ শাহ কোটলায় সিরিজের প্রথম টেস্টে তাঁদের গৃহীত কৌশল অনেকের ভ্রুক্রটি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিপক্ষ সফরকারী ইংল্যান্ডকে ২০৩ রানে গুটিয়ে দেয়ার পর ৬৪/২ থাকা অবস্থায় তাঁরা জুটি গড়েন। দ্বিতীয় দিন শেষে দলের সংগ্রহ ১৮৬/২ দাঁড়ায়। শেষ দেড় ঘণ্টায় তাঁরা ৩৯ রান যুক্ত করেন। এ পর্যায়ে বিজয় মার্চেন্ট শতক হাঁকান। তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশন পর্যন্ত ব্যাটিং করেন। ৫ ঘণ্টা ১০ মিনিট ব্যয় করে তাঁরা ২১১ রান তুলেন। স্ট্যাদাম মন্তব্য করেন যে, যেখানে দুই কিংবা তিন রান স্বাচ্ছন্দ্যে দৌঁড়ে সংগ্রহ করা যায়, সেখানে তাঁরা প্রায়শঃই মাত্র একবার প্রান্ত বদল করেছিলেন। এমনকি ক্লান্ত ইংরেজ বোলিং আক্রমণের বিপরীত উইকেটে থিতু অবস্থায়ও তাঁরা দ্রুতলয়ে রান তুলতে তৎপর হননি।
অবশেষে সাড়ে সাত ঘণ্টা ব্যাটিংয়ের পর স্ট্যাদামের বলে ১৫৪ রান তুলে বিজয় মার্চেন্ট বিদেয় নেন। ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অ্যাডিলেডে বিজয় হাজারের সংগৃহীত ১৪৫ রান অতিক্রম করে ভারতের পক্ষে নতুন টেস্ট রেকর্ড গড়েন। কিন্তু, অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে চাবিরতিতে বিশাল রানে এগিয়ে থাকা অবস্থায় ইনিংস ঘোষণা করেন। এ পর্যায়ে আট ঘণ্টা ৩৫ মিনিট ব্যয় করে ১৬৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে রেকর্ডটি নিজের করে নেন। ইংল্যান্ড দল চূড়ান্ত দিনে ড্র রাখার মানসে ব্যাটিংয়ে নামলে বিরাট সমালোচনার ঢেউ উঠে। তবে, উভয় খেলোয়াড়ই ধীরলয়ে রান সংগ্রহ ও ইনিংস ঘোষণার বিলম্বের বিষয়ে নিজেদের মাঠে স্নায়ুযুদ্ধের বিষয়টি অস্বীকার করেন।
সব মিলিয়ে টেস্টগুলো থেকে সাত শতক সহযোগে ৪৭.৬৫ গড়ে ২১৯২ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তাসত্ত্বেও মাত্র তিন টেস্ট বিজয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। ১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় ভারত দলের প্রথম সফরের সাথে যুক্ত ছিলেন ও সেরা খেলা প্রদর্শন করে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টের উভয় ইনিংসে শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন। অ্যাডিলেডে ডন ব্র্যাডম্যানের নেতৃত্বাধীন ‘অপরাজেয়’ দলের বিপক্ষে ঐ শতকগুলো করেছিলেন। একচেটিয়া ঐ খেলায় অস্ট্রেলিয়ার ৬৭৪ রানের পর্বতসম ইনিংসের বিপরীতে ফলো-অনের কবলে পড়ে রে লিন্ডওয়াল, কিথ মিলার, আর্নি তোশ্যাক, কলিন ম্যাককুল ও ইয়ান জনসনের ন্যায় বোলারদের রুখে ১৪৫ রান তুলেছিলেন। দলীয় সঙ্গীদের ছয়জন ব্যাটসম্যান কোন রান সংগ্রহে ব্যর্থ হয় এবং স্বাগতিক দল ইনিংস ও ১৬ রানে জয় তুলে নেয়। এর পূর্বে প্রথম ইনিংসে ১১৬ রানের অসাধারণ ইনিংস উপহার দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের কল্পলোকে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এক টেস্টের উভয় ইনিংসে উপর্যুপরী শতক হাঁকানোর একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার ছিলেন। পরবর্তীতে, ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে একই মাঠে বিরাট কোহলি তাঁর ঐ রেকর্ডের সাথে যুক্ত হন।
ঐ সিরিজে ভারতীয় বোলারেরা ডন ব্র্যাডম্যানকে চারবার বিদেয় করতে সমর্থ হয়। তন্মধ্যে, তিনিই দুইবার ডন ব্র্যাডম্যানের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেছেন। পরবর্তীকালে এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন যে, শতকগুলোর চেয়েও ডন ব্র্যাডম্যানের উইকেট লাভ করাকে তিনি এগিয়ে রেখেছেন। কার্যকর মিডিয়াম-পেস বোলিং করে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ২৪.৬১ গড়ে ৫৯৫ উইকেট দখল করেছেন।
এছাড়াও, ভারতের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে উভয় ইনিংসে শূন্য রান লাভের অমর্যাদাকর রেকর্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। ১৯৫১-৫২ মৌসুমে কানপুর টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এ ঘটনার শিকার হন। প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে সহস্র রান সংগ্রহের মাইলফলকে পৌঁছেন। উপর্যুপরী তিন টেস্টে শতক হাঁকানো প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যানের মর্যাদা পেয়েছেন। প্রথম ভারতীয় খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫০টি শতক হাঁকানোর গৌরব অর্জন করেন।
সব মিলিয়ে চৌদ্দবার ভারত দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম নিজেকে যুক্ত করেন। সিরিজের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রেড ট্রুম্যানের তোপে পরে ভারতে দলের সংগ্রহ শুরুতেই ০/৪ হলে তিনি ৫৬ রান তুলে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রথম ইনিংসেও তিনি ৮৯ রান তুলেছিলেন। অধিনায়কত্ব লাভের গুরুদায়িত্ব পালনের ফলে তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়াও, দলীয় সঙ্গীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা না পাবার ফলে তাঁর খেলোয়াড়ী জীবন সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয় মার্চেন্টের অভিমত, ‘যদি অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত না হতেন তাহলে হয়তোবা তিনি ভারতের সেরা ব্যাটসম্যানের মর্যাদা পেতেন।’
অ্যাডিলেড টেস্টের পর থেকে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক – প্রত্যেক টেস্ট সিরিজেই তাঁর উপস্থিতি ছিল। ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চসংখ্যক রান তুলেছেন। যদি এতে ব্যর্থ হতেন, তাহলে ব্যাটিং গড়ে শীর্ষে অবস্থান করতেন। এ পাঁচ বছরে ইনিংস প্রতি ৬৯ গড়ে ৩১৮৬ রান সংগ্রহ করেছেন। তন্মধ্যে, ২২ টেস্টে ৬০.৪৮ গড়ে ১৮৭৫ রান ও অনানুষ্ঠানিক টেস্টগুলোয় ৮৭.৪০ গড়ে ১৩১১ রান পেয়েছেন। চার নম্বর অবস্থানে ব্যাটিং করতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এ পর্যায়ে ইনিংসের ভিত্তি গড়ার দিকেই অধিক মনোনিবেশ ঘটাতেন। একনিষ্ঠ শুভাকাঙ্খী জন আর্লট ১৯৪৬ সালের ইংল্যান্ড সফর সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘বিজয় হাজারে কখনো তাঁর রান সংগ্রহ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন না ও উইকেট থেকে বিদেয় নেয়ার পর আক্ষেপ প্রকাশ করতেন। শতক, দ্বি-শতক এগুলো তাঁর কাছে গৌণ ছিল … রান সংগ্রহ সম্পর্কে সজাগ থাকতেন।’ তবে তিনি নিভৃতচারী ছিলেন।
১৯৫০ সালে নিজের সর্বাপেক্ষা নিখুঁত ও সেরা ইনিংস খেলেছেন বলে মন্তব্য করেন। বোম্বেতে কমনওয়েলথ দলে বিপক্ষে ১১৫ রান তুলেন। জিম লেকার ঐ খেলা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ঐ খেলায় নিজের সেরা বোলিংশৈলী প্রদর্শন করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কয়েকটিমাত্র খেলায় অংশ নিলেও যখনই অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন তখনই তা চিরভাস্কর করে রাখার তৎপরতা দেখিয়েছেন। প্রচলিত রয়েছে যে, ভারতীয় ক্রিকেট আঙ্গিনায় পেন্টাগুলার ও রঞ্জী ট্রফি প্রতিযোগিতায় তিনি বিরাট সাফল্য পেলেও টেস্ট ক্রিকেটে তা মেলে ধরতে পারেননি। পেন্টাগুলারের একটি খেলায় দলের সংগ্রহ ৩৮৭ রানের মধ্যে একাই তুলেছিলেন ৩০৯ রানের স্বপ্নীল ইনিংস।
সকল ধরনের বোলিংয়ের বিপক্ষেই ভালোমানের ক্রীড়াশৈলী উপহার দিয়েছেন। ১৯৫২ সালে ফ্রেড ট্রুম্যান তাঁর অভিষেক টেস্টে সিরিজ চলাকালীন মন্তব্য করেন যে, ‘ঐ সময়ে ফাস্ট বোলিংয়ের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানো চমৎকার খেলোয়াড় ছিলেন। শীর্ণকায়, সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে গ্রীক খুঁটির ন্যায় দণ্ডায়মান থাকতেন।’ এছাড়াও তিনি তাঁকে সঠিকমানের ‘ভদ্রলোক’ হিসেবে আখ্যায়িত করে গেছেন। তবে, রুসি মোদি’র অভিমত, লেগ-স্পিন বোলিংয়েই অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। রাজ সিং দুঙ্গারপুরের মতে, স্ট্রোক খেলাকালীন তাঁর হাত কখনো উপরে আবার কখনো হাতলের নিচে নিয়ে যেতেন যা অনেকটা বাঁশী হাতে নিয়ে বাঁশুরিয়ার মতো ছিল।
১৯৫২-৫৩ মৌসুমে অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে ভারতীয় দলকে নিয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ সফরে যান। ২৮ মার্চ, ১৯৫৩ তারিখে কিংস্টনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের পঞ্চম টেস্টে অংশ নেন। ১৬ ও ১২ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ০/৪৭ ও ০/১ বোলিং বিশ্লেষণের পাশাপাশি খেলায় দুইটি ক্যাচ মুঠোয় পুড়েছিলেন। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ায় ও স্বাগতিকরা পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি ১-০ ব্যবধানে জয় করে নেয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে অংশগ্রহণ ছিল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জগৎকে বিদেয় জানালেও ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে সরব ছিলেন। দলের সঙ্কট মোচনে তাঁর অসামান্য ভূমিকা গ্রহণের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সর্বদাই দলের বিপর্যয় রোধে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অ্যাডিলেড টেস্টে তাঁর বীরোচিত অংশগ্রহণের কারণে নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। কিছু সময়ের জন্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখলেও যখনই সুযোগ পেয়েছেন তা পাকাপোক্ত করে গেছেন।
৫১ বছর বয়সে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এ সময়ে ৫৮.৩৮ গড়ে ৬০ শতক সহযোগে ১৮৭৪০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর বোলিং রেকর্ড সাধারণমানের হলেও বল হাতে নিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ৫৯৫ উইকেটের মধ্যে টেস্টে ২০ উইকেট পেয়েছেন ২৫-এরও কম গড়ে। মিডিয়াম-পেসের সাথে লেগ-কাটার জুড়ে দিয়ে ডন ব্র্যাডম্যানসহ অনেককেই ভুগিয়েছেন। দলের প্রয়োজনে নতুন বল নিয়েও আক্রমণে অংশ নিতেন। বারো গজ দূর থেকে দৌঁড়ে আসতেন। তাঁর বোলিংয়ের ধরন অনেকাংশেই রাউন্ড আর্ম ভঙ্গীমায় ছিল। উভয় দিক দিয়ে বলকে সুইং করাতে পারতেন। এছাড়াও, অফ-ব্রেক ও লেগ-ব্রেকে দক্ষ ছিল। তন্মধ্যে, অদ্ভূত ভঙ্গীমায় চার আঙ্গুলে লেগ-ব্রেক বোলিং করতেন ও এতে কব্জীর কোন সম্পর্ক ছিল না। কখনোবা এটি সোজা বরাবর উইকেটে ধেয়ে আসতো। অবসর পরবর্তীকালে ভারতের দল নির্বাচকের দায়িত্বে ছিলেন।
কলকাতাভিত্তিক মোহনবাগানের পক্ষে যুক্ত হন। শুরুতে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় বিসিসিআই কর্তৃপক্ষ তাঁর নামানুসারে রাখে। পরবর্তীতে, সীমিত-ওভারের ঘরোয়া লিস্ট-এ প্রতিযোগিতার নাম পুণঃনামাঙ্কিত করে বিজয় হাজারে ট্রফি রাখা হয়। ২০০২-০৩ মৌসুমে ঘরোয়া একদিনের ট্রফি প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী আসরে তাঁর সম্মানার্থে বিজয় হাজারে ট্রফি রাখা হয়। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হন। জসু প্যাটেলের সাথে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এ পদক পান। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। আরভি হাজারে নামীয় সন্তানের জনক। দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যান্সারে ভোগার পর ৮৯ বছর ২৮২ দিন বয়সে ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৪ তারিখে বরোদায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ১৯৯৭ সালে ক্যান্সারের জীবাণুর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। মৃত্যুর এক সপ্তাহ জীবন-সহায়তা পদ্ধতিতে তাঁকে রাখা হয়েছিল। বিসিসিআই থেকে তাঁর চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা হয়।