১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ তারিখে নিউ সাউথ ওয়েলসের বেলিঙ্গেন এলাকায় জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার, কোচ ও ধারাভাষ্যকার। মূলতঃ উইকেট-রক্ষক-ব্যাটসম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। উইকেট-রক্ষকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বামহাতে ব্যাটিং ও ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সকল স্তরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্ট্যানলি গিলক্রিস্ট ও জুন গিলক্রিস্ট দম্পতির সন্তান। ‘গিলি’ কিংবা ‘চার্চি’ ডাকনামে ভূষিত অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ১.৮৬ মিটার উচ্চতার অধিকারী। ১৯৯২-৯৩ মৌসুম থেকে ২০০৭-০৮ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান রাখেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে নিউ সাউথ ওয়েলস ও ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে মিডলসেক্সের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও, ডেকান চার্জার্স, আইসিসি বিশ্ব একাদশ ও কিংস ইলাভেন পাঞ্জাবের পক্ষে খেলেছেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বমোট ৯৬ টেস্ট, ২৮৭টি ওডিআই ও ১৩টি টি২০আইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়া দলের প্রধান চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ২৫ অক্টোবর, ১৯৯৬ তারিখে ফরিদাবাদে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওডিআইয়ে অংশ নেয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে প্রবেশ করেন।
১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে নিজ দেশে ওয়াসিম আকরামের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী দলের মুখোমুখি হন। ৫ নভেম্বর, ১৯৯৯ তারিখে ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত সফররত পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে অংশ নেন। স্কট মুলারের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। অপূর্ব ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনে অগ্রসর হন। একবার ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পেয়ে ৮১ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, পাঁচটি ক্যাচ ও একটি স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়ান। তবে, মাইকেল স্ল্যাটারের অনবদ্য ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে খেলায় পাকিস্তান দল ১০ উইকেটে পরাজয়বরণ করে ও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
একই মৌসুমে স্টিভ ওয়াহ’র নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড গমন করেন। ৩১ মার্চ, ২০০০ তারিখে হ্যামিল্টনে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। খেলায় তিনি ৭৫ ও ০* রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, দশটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলীর কল্যাণে স্বাগতিকরা ৬ উইকেটে জয় পেলে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়।
২০০১-০২ মৌসুমে নিজ দেশে স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের মুখোমুখি হন। ৮ নভেম্বর, ২০০১ তারিখে সফররত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। ব্যাট হাতে নিয়ে ১১৮ ও ২০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, দুইটি ক্যাচ ও একটি স্ট্যাম্পিংয়ের সাথে নিজেকে জড়ান। তবে, ব্রেট লি’র প্রাণান্তঃকর অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন সত্ত্বেও খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
একই মৌসুমে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে স্টিভ ওয়াহ’র নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০০২ তারিখে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন ও ব্যক্তিগত সাফল্যের সাথে নিজেকে জড়ান। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ১৫২ রান অতিক্রম করেন। খেলায় তিনি ২০৪* রান তুলেন। পাশাপাশি, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে তিনটি ক্যাচসহ একটি স্ট্যাম্পিং করেছিলেন। তাঁর অসাধারণ দ্বি-শতকের কল্যাণে স্বাগতিকরা ইনিংস ও ৩৬০ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে পিছিয়ে পড়ে। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
একই সফরের ৮ মার্চ, ২০০২ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। ব্যাট হাতে নিয়ে ১৩৮* ও ২৪ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, উইকেটের পিছনে অবস্থান করে পাঁচটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। তবে, শেন ওয়ার্নের দূর্দান্ত অল-রাউন্ড সাফল্যে স্বাগতিক দল ৪ উইকেটের ব্যবধানে পরাজিত হলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে।
২০০৩-০৪ মৌসুমে রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে শ্রীলঙ্কা গমন করেন। ১৬ মার্চ, ২০০৪ তারিখে ক্যান্ডিতে অনুষ্ঠিত সফররত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। ব্যাট হাতে নিয়ে ০ ও ১৪৪ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, ছয়টি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। তবে, শেন ওয়ার্নের অসাধারণ বোলিং সাফল্যে সফরকারীরা ২৭ রানে জয় পেলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজে এগিয়ে যায়।
২০০৪-০৫ মৌসুমে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে রিকি পন্টিংয়ের নেতৃত্বাধীন অজি দলের সদস্যরূপে নিউজিল্যান্ড সফরে যান। পুরো সিরিজে অসাধারণত্বের পরিচয় দেন। ১০ মার্চ, ২০০৫ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। একবার ব্যাটিংয়ে নেমে ১২১ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, তিনটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছেন। তাঁর অসাধারণ ব্যাটিংশৈলীর কল্যাণে সফরকারী ৯ উইকেটে জয় পেলে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
এরপর, ১৮ মার্চ, ২০০৫ তারিখে ওয়েলিংটনে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। দূর্দান্ত ক্রীড়াশৈলীর ছাঁপ রাখেন। দলের একমাত্র ইনিংসে ১৬২ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, দুইটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসর হন। তাঁর অসাধারণ শতকের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে সফরকারীরা ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়। খেলায় তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার লাভ করেন।
একই সফরের ২৬ মার্চ, ২০০৫ তারিখে অকল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। একবার ব্যাট হাতে নিয়ে ৬০* রান সংগ্রহসহ দুইটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দীকরণে অগ্রসর হন। দলনায়কের অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে স্বাগতিকরা ৯ উইকেটে পরাজিত হলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ খোঁয়ায়। এ সিরিজে ৩৪৩ রান সংগ্রহ করে ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরস্কার লাভ করেন।
২০০৬ সালের অ্যাশেজ সিরিজে অংশ নেন। পার্থে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শতরানের ইনিংস খেলেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় দ্রুততম শতক হিসেবে পরিগণিত হয়। ৫৭ বল থেকে তিন অঙ্কের কোটা স্পর্শ করেছিলেন। এছাড়াও, ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। চূড়ান্ত খেলায় ১০৪ বল থেকে ১৪৯ রান তুলে দলের শিরোপা বিজয় নিশ্চিত করেন।
২০০৭-০৮ মৌসুমে নিজ দেশে অনিল কুম্বলে’র নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দলের মুখোমুখি হন। ২৪ জানুয়ারি, ২০০৮ তারিখে অ্যাডিলেডে অনুষ্ঠিত সফররত ভারতের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। খেলায় তিনি দলের একমাত্র ইনিংসে ১৪ রান সংগ্রহসহ ছয়টি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। বিখ্যাত ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকরের অসামান্য ব্যাটিংয়ের কল্যাণে খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালেও স্বাগতিকরা ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জয় করে নেয়। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
টেস্টগুলো থেকে ৫৫৭০ রান ও ওডিআই থেকে ৯৬১৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। শতাব্দীর সেরা বলের তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থানে থাকা শোয়েব আখতারের বল মোকাবেলা করেছিলেন। এছাড়াও, একই তালিকায় ত্রয়োদশ অবস্থানে থাকা ইরফান পাঠানের বল মোকাবেলা করেন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর ধারাভাষ্যকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। মাইকেল ভন, শেন ওয়ার্ন ও মাইক হাসিকে নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯ তারিখে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন আলোচনা-পর্যালোচনায় মত্ত ছিলেন।
২০০২ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটার, ২০০৩ ও ২০০৪ সালে একদিনের আন্তর্জাতিকের বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের সম্মাননাপ্রাপ্ত হন। ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক বোলারদের ভোটে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ভীতিদায়ক ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁকে চিত্রিত করা হয়। প্রবল বিক্রমে অগ্রসরমান অস্ট্রেলিয়া দলের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। ২০০৩ সালে অ্যালান বর্ডার পদক লাভ করেন। ২০১০ সালে ওয়াল্টার লরেন্স ট্রফি লাভ করেন। ২০১২ সালে স্পোর্টস অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেম ও ২০১৩ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন। এছাড়াও, ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট হল অব ফেমে ঠাঁই পান।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। হাই স্কুল জীবনের বান্ধবী ও খাদ্যবিশারদ মেলিন্ডা গিলক্রিস্টের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির তিন পুত্র – হ্যারিসন, আর্চি ও টেড এবং অ্যানি জিন নাম্নী কন্যা রয়েছে।
