১১ সেপ্টেম্বর, ১৯১১ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কপুর্থালা এলাকায় জন্মগ্রহণকারী ক্রিকেটার, সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার ও প্রশাসক ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে ভূমিকা রেখে গেছেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে মিডিয়াম বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি, উইকেট-রক্ষকেরও দায়িত্ব পালন করতেন। ভারত দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাঞ্জাবের কপুর্থালায় সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও লাহোরে শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। সন্দেহাতীতভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বাপেক্ষা বর্ণাঢ্যময় ক্রিকেটারের মর্যাদা পেয়েছেন। ভারতের পক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম শতরানের ইনিংস খেলার কৃতিত্বের অধিকারী হন।
শৈশবে স্থানীয় কাঠমিস্ত্রী উপহারস্বরূপ ক্রিকেট ব্যাট তাঁর মাতাকে দিলে তিনি তা লাভ করেন। লাহোরের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। লাহোরে হকি ও দীর্ঘপাল্লার দৌঁড়ে অংশ নিতেন। পরবর্তী বছরগুলোয় ক্রিকেটের প্রতি তাঁর সুগভীর আগ্রহ জন্মায়। লাহোরে ক্লাব ক্রিকেটে অংশ নিতেন। সর্বদাই তাঁর মাঝে হার না মানার মানসিকতা বিদ্যমান ছিল। ধারাবাহিক ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শনের কারণে লাহোরে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। পাতিয়ালার সাথে জড়িত অস্ট্রেলীয় কোচ ফ্রাঙ্ক টারান্ট সর্বপ্রথম তাঁর মাঝে প্রতিভা লক্ষ্য করেন। ভারতীয় বোর্ডে তিনি অমরনাথের নাম সুপারিশ করেন।
১৯২৯-৩০ মৌসুম থেকে ১৯৬৩-৬৪ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর ভারতীয় ক্রিকেটে গুজরাত, হিন্দু, পাতিয়ালার মহারাজা একাদশ, রেলওয়েজ, সাউদার্ন পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পেন্টাগুলার প্রতিযোগিতায় হিন্দু দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৩৮ সালে ব্রাবোর্ন স্টেডিয়ামে ২৪১ রান তুলেন। প্রতিযোগিতার ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ হিসেবে চিত্রিত হয়। ১৯৪০ সালে সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিভাজন সৃষ্টির কারণে কংগ্রেস দল পেন্টাগুলার বন্ধের আবেদন জানায়। তিনিও এতে সম্মত হন ও পেন্টাগুলার প্রতিযোগিতায় খেলা বন্ধ করে দেন।
১৯৩৩ সালে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বাধীন সফররত এমসিসি’র বিপক্ষে ১০৯ রান তুলে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেন। উইকেট-রক্ষক ও উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলায় অংশ নেন। এ পর্যায়ে নবি ক্লার্ক ও স্ট্যান নিকোলসের সাথে বিখ্যাত তারকা ক্রিকেটার হ্যাডলি ভ্যারিটি’র বল মোকাবেলা করে শতক হাঁকান। ফলশ্রুতিতে, একই দলের বিপক্ষে খেলার জন্যে পাতিয়ালা দলের সদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৫৩ রান তুলে বোম্বে জিমখানা মাঠে অনুষ্ঠিত সিরিজের প্রথম টেস্টে তাঁকে দলে রাখা হয়।
১৯৩৩ থেকে ১৯৫২ সময়কালে ভারতের পক্ষে সর্বমোট ২৪ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৩৩-৩৪ মৌসুমে নিজ দেশে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৩ তারিখে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টে প্রথমবারের মতো অংশ নেন। ভারতের লক্ষ্মীদাস জাই, বিজয় মার্চেন্ট, রুস্তমজী জামশেদজী, লধা রামজী এবং ইংল্যান্ডের আর্থার মিচেল ও ব্রায়ান ভ্যালেন্টাইনের সাথে তাঁর একযোগে টেস্ট অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। স্মর্তব্য যে, ভারতের মাটিতে এটিই প্রথম টেস্ট ছিল। প্রায় ৫০,০০০ দর্শক খেলাটিকে স্মরণীয় রাখতে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের সংগৃহীত ২১৯ রানের মধ্যে ধীরস্থির লয়ে ৩৮ রান তুলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।
দ্বিতীয় ইনিংসে দলীয় সংগ্রহ ২১/২ থাকা অবস্থায় অধিনায়ক সিকে নায়ড়ু’র সাথে যোগ দেন। অধিনায়কের আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ও ফুরফুরে মেজাজ তাঁর মাঝেও প্রবাহিত হতে থাকে। ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৩ তারিখে প্রান্ত বদল করে ভারতের প্রথম শতরানের ইনিংস খেলার গৌরব অর্জন করেন। দর্শকদের উচ্ছ্বাসে মাঠ প্রায় পাঁচ মিনিট দখলে ছিল। প্রতিপক্ষীয় উইকেট-রক্ষক হ্যারি এলিয়ট অধিনায়ককে রান-আউট করলেও দিন শেষে তিনি ১০২ রানে অপরাজিত অবস্থায় মাঠ ছাড়েন। কাছাকাছি থাকা রমণীরা তাঁদের অলঙ্কার তাঁকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে থাকে।
তাৎক্ষণিকভাবে বীর বনে যান। পুরো দেশে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তাজমহল হোটেলে তাঁর কক্ষটি উপহারে পরিপূর্ণ ও অভিনন্দন বার্তায় ভরে যায়। পোরবন্দর ও ধাঙ্গাদ্রার মহারাজা স্মারক উপহার দেন। পরের দিন অবশ্য ভারত দল পরাজিত হয়। ১৮৫ বল মোকাবেলান্তে ২১টি চারের মারে ১১৮ রান তুলে নবি ক্লার্কের বোলিংয়ে স্ট্যান নিকোলস তাঁকে তালুবন্দী করলে বিদেয় নিতে হয়েছিল। তাঁর এ সাফল্য সর্বত্র আলোচিত হতে থাকে। খেলায় সফরকারী ইংল্যান্ড দল ৯ উইকেটে বিজয়ী হয় ও তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
তবে, কলকাতা ও মাদ্রাজ টেস্টে ব্যাট হাতে তেমন সফলতা পাননি। তন্মধ্যে, মাদ্রাজে ৪ উইকেট দখল করেছিলেন। তাসত্ত্বেও, তিনি তারকা খ্যাতি লাভ করতে থাকেন। এমনকি, বোম্বের বিখ্যাত স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কনিষ্ঠা কন্যার কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাবনা পান।
১৯৩৫ সালে জ্যাক রাইডারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলীয় একাদশ অনানুষ্ঠানিক টেস্ট খেলতে ভারত সফরে আসে। বোম্বেতে অনুষ্ঠিত প্রথম অনানুষ্ঠানিক টেস্টে ৩৩ ও ৪১ রান করেন। সম্ভবতঃ কলকাতায় তিনি তাঁর সেরা ইনিংস খেলেছিলেন। ব্যাটিং অনুপযোগী পিচে চার্লি ম্যাককার্টনি ও রন অক্সেনহামের তোপে পড়ে ৪৮ রানে গুটিয়ে গেলে মোহাম্মদ নিসার পাল্টা আঘাত হেনে সফরকারীদেরকে ৯৯ রানে গুটিয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। দ্বিতীয় ইনিংসে টমাস লেদারের বল তাঁর চোয়াল স্পর্শ করলে রিটায়ার হার্ট হন। আঘাত নিয়ে নিম্নমূখী রানের খেলায় ৩৯ তুলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।
১৯৩৬ সালে জাহাজযোগে ইংল্যান্ড গমনের পূর্বে পতৌদির নবাব, সি. কে. নায়ড়ু ও পাতিয়ালার যুবরাজকে পাশ কাটিয়ে কোনরূপ প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণবিহীন ‘ভিজ্জি’ ডাকনামে পরিচিত বিজয়ানন্দ গজপতি রাজুকে ভারত দলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। সফরের শুরুতে বেশ ভালো করেন। নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে ১১৪ রানে অপরাজিত ইনিংস খেলেন। এরপর, মিডলসেক্সের বিপক্ষে ৬/২৯ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। এ সময়ে ফিল্ডিংয়ের অবস্থান নিয়ে ভিজ্জি’র সাথে সমঝোতা হয়। মাঠে অধিনায়কের সাথে মতবিরোধ ঘটে। বল মাটিতে ফেলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। দলীয় ব্যবস্থাপক জ্যাক ব্রিটেন-জোন্স নারীঘটিত মিথ্যা অভিযোগে দোষারোপের চেষ্টা চালান। পিঠের ব্যথা নিয়েও অধিকাংশ খেলায় অংশ নেন ও দীর্ঘ সময় ধরে বোলিং করতে থাকেন।
এসেক্সের বিপক্ষে অসাধারণ খেলেন। দলের ১৮৪ রানের মধ্যে নিজে করেন ১৩০ রান ও পরবর্তীতে ৪/৫৪ বোলিং পরিসংখ্যান গড়লে এসেক্স দল ১৬৭ রানে এগিয়ে যায়। এরপর, ভারত দলের ২২৭ রানের মধ্যে নিজে করে ১০৭ রান। খেলায় কোন ব্যাটসম্যানই অর্ধ-শতরানের সন্ধান পায়নি। ৬১ রানের জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছলেও তিনি বোলিং অপরিবর্তিত রেখে ২/২৭ পান।
১১ খেলা থেকে ৫৯১ রান ও ৩১ উইকেট পান। ঐ মৌসুমে দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন এবং ১০০০ রান ও ১০০ উইকেট লাভের ন্যায় ‘ডাবল’ লাভের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। মাইনর কাউন্টিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় উইকেটে বিজয় মার্চেন্ট ও মুশতাক আলী ২১৫ রানের জুটি গড়লে পরবর্তী ব্যাটসম্যান হিসেবে মাঠে নামার অপেক্ষায় থাকেন। অপরদিকে ভিজ্জি তাঁকে পাশ কাটিয়ে অমর সিং, সিএস নায়ড়ু ও ওয়াজির আলীকে মাঠে নামান। অবশেষে খেলা শেষ হবার অল্প কিছু সময় পূর্বে তাঁকে মাঠে নামানো হয়। অপরাজিত অবস্থায় প্যাভিলিয়নে ফিরে এসে ব্যাট ঢিল আকারে ছুঁড়ে পাঞ্জাবী ভাষায় অকথ্য বচন করেন।
ভিজ্জি’র অনুরক্ত, দলীয় কোষাধ্যক্ষ ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এসএম হাদী এ ঘটনায় ভিজ্জি ও ব্যবস্থাপক জ্যাক ব্রিটেন-জোন্সের সাথে হাত মেলান। খেলার পর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে তাঁকে দ্রুত ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা বলা হয়। সিকে নায়ড়ু, ওয়াজির আলী, মোহাম্মদ নিসার ও কোটার রামস্বামী তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসেন ও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করেন। তবে, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। ফলে, ঐ সফরে তিনি কোন টেস্টে অংশ না নিয়েই ব্রিটিশ উপকূল ত্যাগ করতে হয়।
উক্ত ঘটনায় ভারতে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অনাড়ম্বর অভ্যর্থনা পান ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বোম্বের তাজমহল হোটেলে অবস্থান করতে থাকেন। তাঁকে বেশ অর্থ খরচ করতে হয় ও ইংল্যান্ড থেকে ভিজ্জি দেশে ফেরার পরপরই বরখাস্ত হন।
১৯৪৬ সালে ইংল্যান্ড গমনার্থে জাতীয় দলে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়। এ সফরে তিনি দূর্দান্ত বোলার হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করেন। দীর্ঘ ১২ বছর পর পরবর্তী টেস্ট খেলার সুযোগ পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরের টেস্ট খেলার জন্যে ১০ বছর অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়। প্রস্তুতিমূলক খেলাগুলোয় অল-রাউন্ড ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। স্বভাবতঃই দলে যুক্ত ছিলেন। এমনকি শেষ টেস্টে অংশ নেয়ার ১২ বছর পরও তাঁকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দলে রাখা হয়েছিল।
লর্ডসে সিরিজের প্রথম টেস্টে অ্যালেক বেডসার ফাঁদে ফেলে তাঁকে শূন্য রানে বিদেয় করেন ও ৭/৪৯ বোলিং পরিসংখ্যান গড়ে ভারতকে ২০০ রানে গুটিয়ে দেন। তবে, তিনিও দূর্দান্তভাবে খেলায় ফিরে আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে বোলিং করেন। ৩৭-১৮-১১৮-৫ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। লেন হাটন, ডেনিস কম্পটন, সিরিল ওয়াসব্রুক ও ওয়ালি হ্যামন্ডকে বিদেয় করে স্বাগতিক ইংল্যান্ড দলের সংগ্রহকে ৭০/৪-এ নিয়ে যান। জো হার্ডস্টাফ জুনিয়র নিচেরসারির ব্যাটসম্যানদের সহায়তায় খেলাকে জিইয়ে রাখেন। ৫/১১৮ বোলিং পরিসংখ্যান গড়ে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখলেও দলে প্রভাব ফেলতে পারেনি। ২২৮ রানে পিছিয়ে থেকে ১৯০/৭ থাকা অবস্থায় ইনিংস পরাজয়ের মুখোমুখি হয় ভারত দল। এ পর্যায়ে আট নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে দূর্দান্ত অর্ধ-শতক হাঁকান ও দলকে ইনিংস পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। তবে, স্বাগতিক দল ১০ উইকেটে জয় পেয়েছিল। দ্বিতীয় টেস্টে একাধারে ৫১ ওভার বোলিং করে পাঁচ-উইকেট পান। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩০ ওভার থেকে তিন উইকেট লাভ করেন। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয়েছিল। তৃতীয় টেস্টটি পরিত্যক্ত হয়।
অপর দুই টেস্টে ব্যাট হাতে তেমন সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেননি। কিন্তু, ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে বল হাতে দারুণ খেলেন। প্রথম ইনিংসে ডেনিস কম্পটন, ওয়ালি হ্যামন্ড ও জো হার্ডস্টাফের উইকেটসহ ৫/৯৬ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে লেন হাটন, জো হার্ডস্টাফ জুনিয়র ও পল গিবের উইকেট নিয়ে ৩/৭১ বোলিং পরিসংখ্যান গড়েন। ঐ টেস্টে ইংরেজদের ১৫ উইকেট পতনের মধ্যে তিনি এ সাফল্য পান। প্রায় সকল প্রস্তুতিমূলক খেলায় বল হাতে অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। সমারসেটের বিপক্ষে খেলার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হ্যারল্ড গিম্বলেটের বিপক্ষে একাধারে অনেকগুলো মেইডেন ওভার লাভ করেছিলেন। বলে বৈচিত্র্যতা না আনায় হতাশাগ্রস্ত গিম্বলেট তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি কখনো হাফ-ভলি উপযোগী বল করেননি?’ এর জবাবে, নিরুদ্বিগ্ন অবস্থায় বলেন যে, ‘হ্যাঁ, ১৯৪০ সালে একবার বোলিং করেছিলাম।’
১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে ভারত প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া সফর করে। বিজয় মার্চেন্টের অনুপস্থিতিতে তাঁকে অধিনায়কের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। সামগ্রিকভাবে এ সফরটি ভারতের জন্যে শোচনীয় ছিল ও ঐ বছরের শেষদিকেই অস্ট্রেলিয়া দল ‘অপরাজেয়’ দল হিসেবে চিত্রিত হয়। সিডনিতে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ভারত দলের জয়ের সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তবে, বৃষ্টির কারণে খেলা পণ্ড হয়ে পড়ে। এমসিজিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে সাত উইকেট দখল করলেও তাঁর জন্যে এ সিরিজটি মোটেই সুবিধের হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে ৪৬ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস খেলেছিলেন ও ভারত দল পাঁচ-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে ৪-০ ব্যবধানে পরাভূত হয়েছিল।
এককথায় ভারতীয়রা বেশ কয়েকবার স্যাঁতস্যাঁতে উইকেটে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তবে, প্রস্তুতিমূলক খেলায় তিনি সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৪৪ ও অপরাজিত ৮৪, ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ২২৮, কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১৭২, তাসমানিয়ার বিপক্ষে ১৭১ ও আরও একবার তাসমানিয়ার বিপক্ষে ১৩৫ রানের ইনিংস খেলেন। সিডনিতে অস্ট্রেলীয় একাদশের বিপক্ষে ডন ব্র্যাডম্যান ৯৯ রানে থাকাকালীন শততম প্রথম-শ্রেণীর শতক হাঁকানোর প্রাক্কালে এ খেলার পূর্বে সফরের কোন খেলায় বোলিং করা থেকে বিরত থাকা গগুমাল কিষেনচাঁদকে বোলিংয়ের জন্যে আমন্ত্রণ জানান। সম্ভবতঃ তারকা খেলোয়াড়কে কিছুটা বিভ্রান্তি আনয়ণে কৌশল গ্রহণ করেন। তবে, তাঁর এ কৌশল কাজে লাগেনি।
এরপর, নিজ দেশে শক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোকাবেলায় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ভারত দল ১-০ ব্যবধানে সিরিজে পরাজিত হয়। ঐ সিরিজে দুইটি অর্ধ-শতক হাঁকান ও তিন উইকেট দখল করেন। এছাড়াও, আঘাতপ্রাপ্ত প্রবীর সেনের পরিবর্তে ৩৭ বছর বয়সে উইকেট-রক্ষণে অগ্রসর হয়েছিলেন। উজ্জ্বীবিত থেকে দলকে প্রথম তিন টেস্টের প্রথম ইনিংসে খেলার নিয়ন্ত্রণ বাইরে চলে গেলেও ব্যাট হাতে নিয়ে রক্ষা করেন। চতুর্থ টেস্টে ভারত দল পরাজিত হয়। বোম্বেতে অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম টেস্টে ৩৬১ রানের জয়ের লক্ষ্যমাত্রায় দলের সংগ্রহ ৯/২ হয়। তিনি নিজেকে মেলে ধরতে সচেষ্ট হন। রুসি মোদি ও পরবর্তীতে বিজয় হাজারে’র সাথে ১৩৯ রানের জুটি গড়েন। দাত্তু ফাড়কর ভারতের প্রথম টেস্ট বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান। শেষ ওভারে ছয় রানের দরকার ও এক বল খেলার পর আম্পায়ার বাপু জোশী খেলার সমাপ্তি টানেন।
এ পর্যায়ে দ্বিতীয়বারের মতো কর্তৃপক্ষের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। বিমাতাসুলভ আচরণে অভিযোগ আনলে আবারও তাঁকে জাতীয় দলের বাইরে রাখা হয়। বোর্ডের সচিব অ্যান্থনি ডি মেলো’র সাথে তর্কে লিপ্ত হন এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক দলে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়। এরফলে, ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে খেলতে থাকেন। অ্যান্থনি ডি মেলো তাঁর বিরুদ্ধে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে খেলা পরিচালনা, অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে না পারা, দেরী করে আসা, স্বীয় আঘাতের কথা বোর্ডকে অবগত না করা, কর্তৃপক্ষের সাথে ঔদত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শন, যোগাযোগ না করাসহ ২৩টি অভিযোগ আনেন। এছাড়াও, সর্বাপেক্ষা গুরুতর অপরাধ হিসেবে ₹৫,০০০ ভারতীয় রূপীর বিনিময়ে শেষ দুই টেস্টে উইকেট-রক্ষক প্রবীর সেনকে দলে রাখার বিষয়টি তুলে ধরেন।
তিনি প্রত্যেকটি অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ ও জবাব দেন। অমরনাথ টেস্টিমোনিয়াল ফান্ডের অংশ হিসেবে অর্থ গ্রহণের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এ ফান্ডটি অ্যান্থনি ডি মেলো’র নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী গঠন করা হয়। তিনি ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে অংশগ্রহণের প্রস্তাবনা ফিরিয়ে দেন ও ভারত জাতীয় দলে খেলার পাশাপাশি সাসেক্সের পক্ষে খেলার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন। তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ১৩ বছর পূর্বেকার ভিজ্জি’র নিষেধাজ্ঞার ন্যায় শুরুতেই সাধারণের কাছে চলে আসে। বাংলার প্রতিনিধি পঙ্কজ গুপ্ত তাঁর দলে ফিরে আসার বিষয়ে বিরাট ভূমিকা রাখেন। পর্যাপ্ত শুনানী কিংবা সুযোগ না দিয়ে তাঁকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অভিযোগ আনা হলে বোর্ড থেকে অ্যান্থনি ডি মেলোকে বাদ দেয়া হয়। এরফলে, পুণরায় টেস্ট দলে অন্তর্ভুক্ত হন, বিজয় হাজারে’র নেতৃত্বে খেলেন ও ১৯৫১-৫২ মৌসুমে মাদ্রাজে ভারতের প্রথম টেস্ট বিজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
১৯৫১-৫২ মৌসুমে নিজ দেশে আব্দুল কারদারের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান দল তাদের প্রথম উদ্বোধনী টেস্ট সিরিজ খেলতে ভারত সফরে আসলে দল নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি ভিজ্জি তাঁকে অধিনায়ক হিসেবে পুণর্বহাল রাখেন। ভারতের প্রথম টেস্ট সিরিজ বিজয় ২-১ ব্যবধানে অর্জিত হলেও ঐ সিরিজে কেবল একবারই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। লখনউয়ে ফজল মাহমুদের তোপে পড়ে ভারত দল পরাজিত হলেও ৬১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন।
১২ ডিসেম্বর, ১৯৫২ তারিখে কলকাতায় সিরিজের পঞ্চম টেস্টে অংশ নেন। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হয়। ১/৩১ ও ০/১ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। এছাড়াও, ব্যাট হাতে ১১ রান সংগ্রহসহ একটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্ট খেলায় অংশগ্রহণ ছিল।
১৯৩৮-৩৯ মৌসুমে ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে খেলেন। সব মিলিয়ে ঐ মৌসুমে ৮৪ উইকেট দখল করেছিলেন। ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ডখ্যাত’ জর্জ হ্যাডলিকে দুই খেলায় দুইবার বিদেয় করেন। উভয় ক্ষেত্রেই এলবিডব্লিউতে আউট করেছিলেন।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর ভারত দলের ব্যবস্থাপক হিসেবে বিদেশ গমন করেন। ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে পাকিস্তান সফরে আম্পায়ারদের সম্ভাব্য দূর্নীতির বিষয়ে সজাগ হন। আম্পায়ারের তালিকা থেকে ইদ্রিস বেগকে বাদ দেয়া হলে জাতীয় দল নির্বাচক ও প্রশিক্ষিত আম্পায়ার হিসেবে মাসুদ সালাহউদ্দীনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
এছাড়াও, ভারতের জাতীয় দল নির্বাচকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে নিজ দেশে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর অস্ট্রেলিয়া ভারত সফরে আসে। দিল্লি টেস্টে ইনিংস ও ১২৭ রানে পরাজিত হলে তিনি স্বীয় ক্ষমতাবলে কানপুরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টের জন্যে জসু প্যাটেলকে যুক্ত করেন। জসু প্যাটেল খেলায় ১৪ উইকেট নিয়ে দলকে ১১৯ রানের জয় এনে দেন।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। ৮ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ তারিখে কৈলাশ কুমারী নাম্নী রমণীর পাণিগ্রহণ করেন। কিছুকাল এ দম্পতি লাহোরে অবস্থান করেন, একত্রে সফরে যান ও পরবর্তীতে পাতিয়ালায় বসতি গড়েন। সুরিন্দর অমরনাথ, মহিন্দর অমরনাথ ও রাজিন্দর অমরনাথ – পুত্রত্রয়কে খেলায় হাতিখড়ি ঘটিয়েছেন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালনসহ ব্যর্থতায় তাঁদের শাসন করতেন। রঞ্জী ট্রফির খেলায় এক পুত্রকে সাজঘর থেকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন ও দূর্বল স্ট্রোকের বিষয়টি তুলে ধরেন। সুরিন্দর অমরনাথ ও মহিন্দর অমরনাথ ভারতের পক্ষে টেস্টে অংশ নিয়েছেন। তন্মধ্যে, সুরিন্দর অমরনাথ পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে টেস্ট অভিষেকে শতক হাঁকিয়ে প্রথম ও একমাত্র পিতা-পুত্রের টেস্ট অভিষেকে শতরান করার কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। রাজিন্দর অমরনাথ রঞ্জী ট্রফিতে হরিয়ানা দলের কার্যকর অল-রাউন্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন।
৫ আগস্ট, ২০০০ তারিখে নয়াদিল্লিতে ৮৮ বছর ৩২৯ দিন বয়সে তাঁর দেহাবসান ঘটে। ২০১১ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিসিসিআই কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে রঞ্জী ট্রফি ও ঘরোয়া সীমিত-ওভারের প্রতিযোগিতায় সেরা অল-রাউন্ডারকে লালা অমরনাথ পুরস্কারে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
