জন রিচার্ড রিড
৩ জুন, ১৯২৮ তারিখে অকল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত ক্রিকেটার ও রেফারি ছিলেন। মূলতঃ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন। ডানহাতে ব্যাটিং করতেন। এছাড়াও, ডানহাতে ফাস্ট-মিডিয়াম কিংবা ডানহাতে অফ-ব্রেক বোলিংয়ে অংশ নিতেন। পাশাপাশি, মাঝে-মধ্যে উইকেট-রক্ষণেও অগ্রসর হতেন। নিউজিল্যান্ড দলের অধিনায়কের দায়িত্বে ছিলেন।
বিদ্যালয় জীবনে খেলাধূলায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৪৩ সালে হাট ভ্যালি হাই স্কুলে থার্ড ফর্মে থাকাকালীন সরাসরি প্রথম একাদশ ও প্রথম পঞ্চদশে খেলার সুযোগ পান। রাগবি ও ক্রিকেট – উভয় খেলায় নিউজিল্যান্ড দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে, দুইবার বাতজ্বরে আক্রান্ত ও হৃদযন্ত্রের সমস্যায় রাগবি খেলোয়াড়ী জীবনের সমাপ্তি টানতে হয়।
আক্রমণাত্মক ধাঁচের অধিকারী ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন। যদি তিনি অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করতেন, তাহলে হয়তোবা মহাতারকায় পরিণত হতেন। স্যার রিচার্ড হ্যাডলি’র সাথে নিউজিল্যান্ডীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা অল-রাউন্ডারের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৭-৪৮ মৌসুম থেকে ১৯৬৪-৬৫ মৌসুম পর্যন্ত সময়কালে প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। ঘরোয়া আসরের প্রথম-শ্রেণীর নিউজিল্যান্ডীয় ক্রিকেটে ওতাগো ও ওয়েলিংটনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৪৮ সালে নববর্ষের দিনে ওয়েলিংটনের সদস্যরূপে ক্যান্টারবারির বিপক্ষে তাঁর প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়। ২৪৬টি প্রথম-শ্রেণীর খেলায় অংশ নিয়ে ১০৫৩৫ রান ও ৪৬৬ উইকেট দখল করেছিলেন। ১৯৬৩ সালে এক ইনিংসে সর্বাধিক ছক্কা হাঁকানোর তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড দাঁড় করান। বেসিন রিজার্ভে ওয়েলিংটনের সদস্যরূপে নর্দার্ন ডিস্ট্রিক্টসের বিপক্ষে ১৫ ছক্কায় ২৯৬ রানের ইনিংস খেলেন। পরবর্তীতে, ১৯৯৫ সালে গ্লুচেস্টারশায়ারের সদস্যরূপে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে ১৬ ছক্কা হাঁকিয়ে তাঁর এ রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেন।
১৯৪৯ থেকে ১৯৬৫ সময়কালে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে সর্বমোট ৫৮ টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে ওয়াল্টার হ্যাডলি’র নেতৃত্বাধীন কিউই দলের সাথে ইংল্যান্ড গমন করেছিলেন। ২৩ জুলাই, ১৯৪৯ তারিখে ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে তাঁর অভিষেক পর্ব সম্পন্ন হয়। খেলায় তিনি ৫০ ও ২৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ০/১৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে চার-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
একই সফরের ১৩ আগস্ট, ১৯৪৯ তারিখে লন্ডনের ওভালে সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের ছাঁপ রাখেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫১ রানে পৌঁছানোকালে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ রান অতিক্রম করেন। ৫ ও ৯৩ রান সংগ্রহ করেন। এছাড়াও, দুইটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। খেলাটি ড্রয়ে পরিণত হলে অমিমাংসিত অবস্থায় সিরিজটি শেষ হয়।
এরপর থেকে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে আরও ৫৭ টেস্টসহ সব মিলিয়ে ৫৮ টেস্ট খেলেন। তন্মধ্যে, ৩৪ টেস্টে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ৩৩-এর অধিক গড়ে ৩৪২৮ রান তুলেছেন। ছয়টি টেস্ট শতক হাঁকিয়েছেন। ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ করেন ১৪২ রান। এছাড়াও, ডানহাতি ফাস্ট-মিডিয়াম বোলার হিসেবে ৮৫ উইকেট দখল করেন।
১৯৫০-৫১ মৌসুমে নিজ দেশে প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলেন। ঐ মৌসুমে ফ্রেডি ব্রাউনের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ১৭ মার্চ, ১৯৫১ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। একবার ব্যাট হাতে নিয়ে ৫০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ০/২৯ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে দুই-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৫৩-৫৪ মৌসুমে জিওফ রাবোনের নেতৃত্বাধীন কিউই দলের সদস্যরূপে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। দুই দলের মধ্যকার প্রথম টেস্ট সিরিজে অংশ নেন। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৫৩ তারিখে জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংসে এইচজে টেফিল্ডকে বিদেয় করে ব্যক্তিগত সেরা বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর পূর্বেকার সেরা ছিল ২/৬৩। খেলায় তিনি ২/৬৩ ও ৪/৩৪ লাভ করেন। এছাড়াও, ব্যাট হাতে নিয়ে ৩ ও ১ রান সংগ্রহসহ তিনটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। সফরকারীরা ১৩২ রানে পরাভূত হলে ২-০ ব্যবধানে সিরিজে পিছিয়ে পড়ে।
এরপর, ১ জানুয়ারি, ১৯৫৪ তারিখে কেপটাউনে অনুষ্ঠিত সিরিজের তৃতীয় টেস্টে অংশ নেন। কয়েকটি ব্যক্তিগত সাফল্যের ছাঁপ রাখেন। প্রথম ইনিংসে ব্যক্তিগত পূর্বতন সর্বোচ্চ ৯৩ রান অতিক্রম করেন। এ পর্যায়ে টেস্টে নিজস্ব প্রথম শতক হাঁকান। খেলায় তিনি একবার ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পেয়ে ১৩৫ রান সংগ্রহ করেছিলেন। তন্মধ্যে, দ্বিতীয় দিনের মধ্যাহ্ন ও চাবিরতির মাঝখানে ১৯* থেকে ১৩৫* রান তুলেছিলেন। এছাড়াও, বল হাতে নিয়ে ০/৪৮ ও ০/৮ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে স্বাগতিকরা ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে যায়।
একই সফরের ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪ তারিখে জিকিবার্হায় অনুষ্ঠিত সিরিজের পঞ্চম ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। ব্যক্তিগত সাফল্যের সন্ধান পান। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৯ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি ১৯ ও ৭৩ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ৪/৫১ ও ১/৬৪ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোসহ একটি ক্যাচ গ্লাভসবন্দী করেছিলেন। স্বাগতিক দল ৫ উইকেটে জয়লাভ করলে ৪-০ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়।
১৯৫৬ সালে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট বিজয়ে দলের নেতৃত্বে ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের চতুর্থ ও চূড়ান্ত খেলায় এ সফলতা পায় তাঁর দল। প্রথম ইনিংসে ৮৪ রান তুলে দলের জয়ের ভিত রচনা করেন। এছাড়াও, ১৯৬১-৬২ মৌসুমে দলের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান। ১৯৬২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদেশের মাটিতে দলের প্রথম জয়ের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখেন। এ সফরে অরেঞ্জ ফ্রি স্টেটের বিপক্ষে প্রস্তুতিমূলক খেলায় ৬৮ মিনিট ব্যাটিং করে শতক হাঁকিয়েছিলেন। কিন্তু, কখনো ইংরেজ দলের বিপক্ষে সফলতার সন্ধান পাননি। বরঞ্চ, ১৯৫৫ সালে ইডেন পার্কে সিরিজে দ্বিতীয় টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ২৬ রানে গুটিয়ে যাবার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। তবে, প্রথম ইনিংসে তাঁর সংগৃহীত ৭৩ রান পুরো খেলায় সর্বোচ্চ ছিল।
১৯৬২-৬৩ মৌসুমে নিজ দেশে টেড ডেক্সটারের নেতৃত্বাধীন এমসিসি দলের মুখোমুখি হন। ১৫ মার্চ, ১৯৬৩ তারিখে ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত সফররত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। প্রথম ইনিংস ইংরেজদের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড দল এগিয়ে যায়। এ পর্যায়ে তিনি ৭৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে দল মাত্র ১৫৯ রানে গুটিয়ে গেলেও তিনি ঠিক ১০০ রান তুলেছিলেন। এটিই শতকসহ টেস্টে সর্বনিম্ন রান সংগ্রহের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও, ১/৩১ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করানোসহ দুইটি ক্যাচ তালুবন্দী করেছিলেন। সফরকারীরা ৭ উইকেটে জয় পেলে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী হয়।
১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে নিজ দেশে ট্রেভর গডার্ডের নেতৃত্বাধীন স্প্রিংবকের মুখোমুখি হন। ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৪ তারিখে ডুনেডিনে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে বেশ কয়েকটি ব্যক্তিগত সাফল্যের ছাঁপ রাখেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ১ রানে পৌঁছানোকালে টেস্টে ২৫০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। খেলায় তিনি উভয় ইনিংসে ২ রান করে সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংসে ডিটি লিন্ডসেকে বিদেয় করে ব্যক্তিগত সেরা বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। তাঁর পূর্বেকার সেরা ছিল ৪/৩৪। এ পর্যায়ে টেস্টে নিজস্ব প্রথম পাঁচ-উইকেট লাভ করেন। বল হাতে নিয়ে ৬/৬০ পান। খেলাটি ড্রয়ের দিকে গড়ালে তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজটি অমিমাংসিত অবস্থায় অগ্রসর হতে থাকে।
১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে কিউই দলের অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে পাকিস্তান গমন করেন। ২৭ মার্চ, ১৯৬৫ তারিখে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে অংশ নেন। এরফলে, উপর্যুপরী ৫৩ টেস্টে অংশ নিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন। ৪ ও ০ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়াও, ৩/৮০ বোলিং বিশ্লেষণ দাঁড় করান। ইনিংস ও ৬৪ রানে জয় পেয়ে স্বাগতিকরা তিন-টেস্ট নিয়ে গড়া সিরিজে এগিয়ে যায়। ছয় বছরের মধ্যে এটি পাকিস্তানের প্রথম জয় ছিল।
১৯৬৫ সালে কিউই দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ইংল্যান্ড গমন করেন। ৮ জুলাই, ১৯৬৫ তারিখে লিডসে অনুষ্ঠিত স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও চূড়ান্ত টেস্টে অংশ নেন। অধিনায়কের দায়িত্বে থেকে খেলায় তিনি ৫৪ ও ৫ রান সংগ্রহ করেছেন। স্বাগতিকরা ইনিংস ও ১৮৭ রানে জয় পেলে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজে জয়লাভ করে। পরবর্তীতে, এটিই তাঁর সর্বশেষ টেস্টে পরিণত হয়।
ক্রিকেট খেলা থেকে অবসর গ্রহণের পর প্রশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। নিউজিল্যান্ডের দল নির্বাচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এক পর্যায়ে কোচ ও ব্যবস্থাপকীয় গুণাবলী নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করেন। কিন্তু, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের সম্মুখসারির মনোনীত রেফারি হিসেবে নিউজিল্যান্ডে ফিরে আসেন। ১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ড স্পোর্টস হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। ১৯৪৬ সালে বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে হাট হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে নর্লি লি ফেব্রে নাম্নী এক সেবিকার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। অতঃপর, ১৯৫১ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। এ দম্পতির তিন সন্তান ছিল। তন্মধ্যে, একমাত্র পুত্র রিচার্ড রিড পরবর্তীতে নিউজিল্যান্ডের পক্ষে নয়টি ওডিআইয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ১৪ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে ৯২ বছর ১৩৩ দিন বয়সে অকল্যান্ডে তাঁর দেহাবসান ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি নিউজিল্যান্ডের বয়োজ্যেষ্ঠ জীবিত টেস্ট ক্রিকেটারের সম্মাননার অধিকারী ছিলেন।